ডা. শাহজাদা সেলিম
২০৪০ সালে এর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ৬৪২ মিলিয়ন-এ। এর মধ্যে সাধারণত প্রাপ্ত বয়স্ক ও সুস্থ মানুষরা রোজা রাখে। পৃথিবীর মোট প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলমানের ৩৬ শতাংশ ডায়াবেটিসে ভুগছে। সে হিসাবে দাঁড়াচ্ছে, প্রতি রমজান মাসে ৯-১২ কোটি ডায়াবেটিস রোগী রোজা রাখছে। টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ৪৩ শতাংশ এবং টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীদের ৭৯ শতাংশ রমজান মাসে রোজা রাখে।
দীর্ঘ সময় একজন ডায়াবেটিস রোগীর না খেয়ে থাকা উচিত হবে কী না তা নিয়ে অনেক বছর ধরে বহু বিতর্ক হয়েছে। অবশেষে পৃথিবীর মুসলমান ও অমুসলমান ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞরা সর্বসম্মতভাবে মতামত দিয়েছেন যে, ডায়াবেটিস রোগীর পক্ষে রোজা রাখা ক্ষতিকর হবে।
কুরআন শরিফেও রোগাক্রান্তদের রোজা রাখা থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে (সূরা আল বাকারা : আয়াত ১৮৩-১৮৫) আর অন্য যে কোনো ধরনের অসুখের চেয়ে ডায়াবেটিস নিয়মিত ও পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। ডায়াবেটিস রোগীর বিপর্যস্ত বিপাকীয় তন্ত্রের কারণে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে শারীরিক নানাবিধ সমস্যা হতে পারে।
রোজা রাখার সময় ডায়াবেটিক রোগীর ঝুঁকিগুলো
* রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা কমে যাওয়া (হাইপোগ্লাইসেমিয়া) : খাদ্য গ্রহণে অনেকক্ষণ ধরে বিরত থাকলে রক্তের গ্লুকোজের পরিমাণ কমতে থাকে। রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ ডায়াবেটিস রোগীর রোজা রাখার সময় এতটাই কমে যেতে পারে যে, তাকে হাসপাতালে ভর্তি পর্যন্ত করতে হতে পারে। টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে এরূপ হাইপোগ্লাইসেমিয়া হওয়ার আশঙ্কা ৪.৭ গুণ এবং টাইপ২ ডায়াবেটিকের ক্ষেত্রে ৭.৫ গুণ বেশি।
* রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া (হাইপারগ্লাইসেমিয়া) : রোজা রাখার কারণে টাইপ১ ও টাইপ২ উভয় ধরনের ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেই রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কিছুটা ঝুঁকি থাকে। টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রে তা মারাত্মক হতে পারে। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে এ থেকে জীবন নাশের ঘটনাও ঘটতে পারে। রমজান মাসের শেষের দিকে এ ঘটনাগুলো ঘটার আশঙ্কা বাড়তে থাকে।
* ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস : টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে রক্তের গ্লুকোজ মারাত্মকভাবে বেড়ে যাওয়া বা এর ধারাবাহিকতায় কিটোনবডি বেড়ে যাওয়ার কারণে সংকটাপন্ন অবস্থায় নিপতিত হতে পারেন। বিশেষ করে যাদের রক্তের গ্লুকোজের নিয়ন্ত্রণ রোজা শুরুর আগে ভালো ছিল না। টাইপ২ ডায়াবেটিস রোগীর ক্ষেত্রেও এরূপ হতে পারে।
* পানি শূন্যতা ও থ্রম্বোএম্বোলিজম : রোজা রেখে দীর্ঘ সময় পানি বা পানীয় খাদ্য গ্রহণে বিরত থাকার কারণে শরীরে পানি শূন্যতা (ডিহাইড্রেশন) দেখা দিতে পারে। গরম ও বেশি আর্দ্র আবহাওয়ায় পানি শূন্যতা আরও প্রকট হতে পারে। যাদেরকে রোজা রেখে কঠোর শারীরিক শ্রম দিতে হয় তাদেরও পানি শূন্যতা দেখা দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাছাড়া রক্তে বেশি মাত্রায় গ্লুকোজ থাকলে শরীর থেকে পানি ও খনিজ পদার্থ বের হয়ে যাওয়ার হার অনেক বৃদ্ধি পায়।
এতে করে বসা বা শোয়া অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ালে মাথা ঘুরে যেতে পারে। বিশেষত, যাদের ডায়াবেটিসের কারণে স্নায়ুবিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, তাদের এ সময় সহসা জ্ঞান হারানো, মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া, আঘাত প্রাপ্ত হওয়া, হাড় ভেঙে যাওয়া ইত্যাদি ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। দেহের পানি শূন্যতার কারণে রক্ত জমাট বেধে চোখের রেটিনার কেন্দ্রীয় শিরা বন্ধ হয়ে দৃষ্টি শক্তি হারাবার ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে ও অন্যান্য মরু অঞ্চলে।
করণীয়
প্রত্যেক রোজাদার ডায়াবেটিক রোগীর অবস্থা তার স্বাতন্ত্রসহ বিবেচনা করতে হবে।
ঘন ঘন রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা দেখতে হবে [প্রতিদিন বেশ ক’বার (কম পক্ষে তিন বার) রক্তে গ্লুকোজ মাপতে হবে]। দিনের শেষ ভাগে অবশ্যই রক্তের গ্লুকোজ দেখার ব্যবস্থা থাকতে হবে। আর টাইপ১ ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে খুব সতর্কতার সঙ্গে রক্তের গ্লুকোজ লক্ষ্য রাখতে হবে। রমজানের প্রথম দিকের দিনগুলোতে একটু বেশি সর্তক থাকতে হবে, পরে অবস্থা বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
প্রতিদিনের খাদ্যের পুষ্টিমান অন্যান্য সময়ের মতোই রাখার চেষ্টা করতে হবে, যদিও তা খুব সহজ নাও হতে পারে। স্বাভাবিক দৈহিক ওজন ধরে রাখার পদক্ষেপ নিতে হবে। রমজানে রোজা রেখে ২০-২৫ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর দৈহিক ওজন কমে বা বাড়ে। ইফতারে চর্বি সমৃদ্ধ খাদ্য এবং তেলে ভাজা খাবার গ্রহণ করা হতে যতটা সম্ভব বিরত থাকতে হবে। কেননা, এসব খাবার হজম হতে সময় লাগবে।
কিন্তু ডায়াবেটিস রোগীর ইফতারের পরপরই যত দ্রুত সম্ভব রক্তে গ্লুকোজ সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা জরুরি। সেজন্য জটিল শর্করা জাতীয় খাবার সেহরির সময় খেতে হবে। আর ইফতারিতে সহজ পাচ্য খাবার খেতে হবে। প্রচুর পানি ও অন্যান্য তরল খাবার খেতে হবে। সেহরির খাবার নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার ঠিক আগে খেতে হবে এবং তারপর প্রচুর পানি পান করা বাঞ্ছনীয়।
শারীরিক শ্রম বা ব্যায়ামসহ স্বাভাবিক শারীরিক কর্মকাণ্ড চালানো যেতে পারে এ সময়। তবে খুব বেশি কঠোর শ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে করে হাইপোগ্লাইসেমিয়া হতে পারে। আর কঠোর শ্রম বিকাল বেলায় তো করা যাবেই না। তারাবি নামাজ পড়লে, তাকে শারীরিক শ্রমের বিকল্প হিসাবে গণ্য করা যেতে পারে। কিছু কিছু ডায়াবেটিস রোগী (বিশেষত টাইপ১) যাদের রক্তের গ্লুকোজ ঠিক মতো রাখা যাচ্ছে না তাদের ক্ষেত্রে হাইপোগ্লাইসেমিয়ার ঘটনা প্রায়শ মারাত্মক হয়।
প্রতিটি ডায়াবেটিস রোজাদারকে একথাটি খুব স্পষ্টভাবে বুঝতে হবে যে, যখনই হাইপোগ্লাইসেমিয়ার কোনো লক্ষণ শরীরে দেখা দেয় তার পর যতটা সম্ভব দ্রুততর সময়ের মধ্যে গ্লুকোজ/চিনি/মিষ্টি কোনো খাদ্য, শরবত ইত্যাদি যে কোনো একটি খেয়ে নিতে হবে।
যাদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়েছে, তারা তো খুব সহজেই এর প্রাথমিক উপসর্গ চিনতে পারবেন। আর যাদের তেমন অভিজ্ঞতা হয়নি, তাদের বুক ধড়ফড়ানি, মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগা, ঘাম হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, চোখে অন্ধকার দেখা, মাথা ঘোরা ইত্যাদির এক বা একাধিক লক্ষণ দেখা দিতে পারে। তখন হাইপোগ্লাইসেমিয়া (রক্তের গ্লুকোজ এ সময় সাধারণত ৩.৩ মিলিমোল/লিটার) হওয়ার কথা।
আবার দিন শুরুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই যদি রক্তের গ্লুকোজ ৩.৯ মিলিমোল/লিটার বা তার চেয়ে কমে যায় তাহলেও কিছু খেয়ে নেয়া জরুরি। আর যারা ইনসুলিন, সালফুনাইলইউরিয়া-মেগ্লিটিনাইড জাতীয় ওষুধ গ্রহণ করছেন, তাদের ক্ষেত্রে এমনটি ঘটার আশঙ্কা বেশ বেশি। আবার রক্তের গ্লুকোজ ১৬.৭ মিলিমোল/ লিটারের বেশি হলেও রোজা রাখা সম্ভব হবে না।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিশেষজ্ঞ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়