চাঁদপুরে বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় লক্ষাধিক মানুষে। বন্যায় আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই শতাধিক পরিবার। জেলার হাইমচরের নীলমকল ইউনিয়ন ভাঙনের কবলে পড়েছে। বন্যায় কারণে জেলার মৎস্য ও ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
টানা বৃষ্টিতে ডাকাতিয়া নদীর পানি ১ থেকে ২ ফুট ওঠানামা করছে বলে জানিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এছাড়া পদ্মা-মেঘনায় রয়েছে প্রবল স্রোত। জেলার হাজীগঞ্জ, শাহরাস্তি ও ফরিদগঞ্জ উপজেলার কয়েকশ পরিবার পানিবন্দী হয়ে আছে। এদের মধ্যে হাজীগঞ্জ উপজেলার ১০নং গর্ন্ধব্যপুর ইউনিয়নের কাশিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অন্তত ২০টি পরিবার, ৯নং গর্ন্ধব্যপুর ইউনিয়নের গুচ্ছগ্রাম এলাকার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও নাসিরকোটের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে কিছু পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রাত থেকে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সদর উপজেলার রাজরাজেশ্বর ও ইব্রাহীমপুর ইউনিয়নের কিছুটা শঙ্কামুক্ত। প্রত্যেক উপজেলায় মনিটরিং করার জন্য কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। অপরদিকে, জেলা পুলিশ প্রশাসন, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশসহ সামাজিক সংগঠনগুলো প্রস্তুত রয়েছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা জাকির হোসেন সৈকত বলেন, ‘উপজেলার কয়েকশ মানুষ মুন্সীরহাটের আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাদের খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে।’
চাঁদপুর উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আতিক হোসেন জানান, ‘জোয়ার-ভাটার প্রভাবের কারণে চাঁদপুরের পদ্মা-মেঘনার পানি সন্ধ্যা ৭টায় ছিল ৩.৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। ৪ সেন্টিমিটার হলে বিপৎসীমার উপরে উঠবে পানি। সেই তুলনায় এখনো চাঁদপুরের অবস্থা স্বাভাবিক রয়েছে।’
অপরদিকে, মতলব উত্তরের পশ্চিম পাশ ঘেঁষে মেঘনা নদীরপাড় দিয়ে বয়ে যাওয়া বেড়িবাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থা রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধে স্বেচ্ছাসেবক টিম স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে কয়েকটি গর্ত মেরামত করতে দেখা যায়।
চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে শনিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ থাকার ঘোষণা দিয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে ক্ষতি হওয়ায় বিদ্যুৎ লাইন মেরামতের কাজ করা হবে বলে জানায় বিদ্যুৎ বিভাগ।
২০০৪ সালের পর এত পানি আর জলবদ্ধতা দেখেনি চাঁদপুরের মানুষ। টানা ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানিতে রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্তের পাশাপাশি ক্ষতির সম্মুখীন হন মৎস্যচাষিরা। জেলার আট উপজেলার মধ্যে সদর উপজেলা, ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলার প্রায় ২০ হাজার পুকুর ও শতাধিক ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ফরিদগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩৫ মাছের প্রজেক্টে। জেলায় প্রায় শত কোটি টাকার মাছ ভেসে গেছে বলে দাবি করছে চাষিরা।
হাজীগঞ্জ পৌরসভার রান্ধুনীমুড়া এলাকার তৃপ্তি মৎস্য ফিশারীর সত্ত্বাধিকারী মুন্সী মোহাম্মাদ মনির। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে মাছ চাষ করে আসছেন। সম্প্রতি এলাকায় ২৭টি পুকুরে রুই, কাতল, থাই পুঁটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ফেলে ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ ভারী বৃষ্টিপাতে পুকুরে পানি ডইডুম্বর হয়ে ভেসে গেছে সব মাছ। এতে তার প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।
হাজীগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা সুলতানা রাজিয়া জানান, তার উপজেলায় ৭০০ হেক্টেরে ৩ হাজার পুকুরে মৎস্য চাষ করা হয়। এদের মধ্যে কার্ডধারী মৎস্য চাষির সংখ্যা ১৬২০ জন। খোঁজ-খবর নিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণসহ তালিকা করা হচ্ছে।
জেলার সবচেয়ে বড় বড় মৎস্য প্রজেক্ট ফরিদগঞ্জ উপজেলায়। এই উপজেলায় অন্তত ৬০টিরও বেশি চরে মৎস্য চাষ করা হচ্ছে। গাজীপুর চরের মৎস্য চাষি মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় ৪০ জন বড় মৎস্য চাষি রয়েছে। শত কোটি টাকার মাছ পানিতে ভেসে গেছে। নেট দিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সরকার যেন এই চাষিদের প্রতি সুনজর দেয়।’
ফরিদগঞ্জ উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘বিভিন্নভাবে প্রজেক্ট ও পুকুরের মাছ রক্ষার পরামর্শ দেওয়ার পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা হচ্ছে।’
জেলায় প্রায় ৪১ হাজার ৭২০টি পুকুর রয়েছে। জেলায় মৎস্য চাষির স্যংখ্যা ৩১ হাজার ১৫ জন। এর মধ্যে ফরিদগঞ্জ ও হাজীগঞ্জে উপজেলার মৎস্যচাষিরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সরকারিভাবে প্রণোদনা বা সহজলভ্যে ঋণ দেওয়ার আহ্বান জানান ক্ষতিগ্রস্ত মৎস্যচাষিরা।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কল্লোল কিশোর সরকার বলেন, ‘বৃষ্টির পানিতে উপজেলার অনেক ফসল নিমজ্জিত। বৃষ্টি কমলে আমরা কৃষকদের পরামর্শ দেব তারা যাতে নাবি জাতের অর্থাৎ আমনের বিআর-২২ ও ২৩ জাত আবাদ করতে। এর জন্য বীজ পরিবেশকদের সঙ্গে কথা বলছি। আর ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট পাঠাব।’
চাঁদপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক ড. মো. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী বলেন, ‘অতিবৃষ্টির কারণে চাঁদপুরে রোপা আমন ব্যাহত হচ্ছে। বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত এবং রোপা আমন লাগানো বিলম্বিত হচ্ছে। এভাবে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকলে রোপা আমনের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হবে। আমরা অন্যান্য দুর্যোগের সময় কৃষকদের যেমন তালিকা করি, এক্ষেত্রে সেভাবে তালিকা করা হবে। যাতে করে পরবর্তী মৌসুমে এসব ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের প্রণোদনার আওতায় আনা যায়।’