ইতিকথা:
এ কথা অনস্বিকার্য সভ্যতার উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক বিদ্যুৎ। ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে আহসান মঞ্জিলে জেনারেটরের সহায়তায় বিদ্যুৎ সরবরাহের মাধ্যমে এই অঞ্চলে বিদ্যুতের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৩০ সালে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় প্রথম বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা চালু হয় এবং পরবর্তীতে বাণিজ্যিকভাবে বিতরণ করার লক্ষ্যে ‘ধানমন্ডি পাওয়ার হাউজ’ স্থাপন করা হয় ।
ভারত উপমহাদেশ স্বাধীনতাকালে, ১৯৪৭ এ এতদ্অঞ্চলে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণের ব্যবস্থা চালু ছিল। তারপর ১৭ টি প্রাদেশিক জেলার শুধুমাত্র শহরাঞ্চলে সীমিত পরিসরে বিদ্যুৎ সরবরাহের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। অধিকাংশ জেলাগুলিতে শুধুমাত্র রাতের বেলায় সীমিত সময়ের জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। ঢাকায় ১৫০০ কিলোওয়াট ক্ষমতার দুটি জেনারেটর এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো।
১৯৪৮ সালে, বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারি পর্যায়ে বিদ্যুৎ অধিদপ্তর স্থাপন করা হয়। ১৯৫৯ সালে পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (ওয়াপদা) স্থাপন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের নবদিগন্তের সূচনা হয় এবং বিদ্যুৎ খাত একটি কাঠামো লাভ করে। ১৯৬০ সালে,বিদ্যুৎ অধিদপ্তরটি ওয়াপদা এর সাথে একুতিভুত হওয়ার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ মাত্রা লাভ করে। উক্ত সময়ে সিদ্ধিরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও খুলনায় অপেক্ষাকৃত বৃহৎ আকারের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়, সিদ্ধিরগঞ্জে স্থাপন করা হয় ১০ মেগাওয়াট ক্ষমতার স্টিম টারবাইন বিদ্যুৎ কেন্দ্র। একই সময়ে, কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে কাপ্তাইয়ে ৪০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইউনিট স্থাপন করা হয়,যা উক্ত সময়ে বৃহৎ বিদ্যুৎ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত ছিল। ১৯৬২ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম ১৩২ কেভি ট্রান্সমিশন লাইন চালু করা হয় যা এই দেশের বিদ্যুৎ বিকাশের মাইলফলক। তথাপিও দেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠির বিদ্যুৎ সুবিধাবিহীন অন্ধকারেই ছিল।
জাতির জনকের স্বপ্ন ও স্বাধীন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত:
বাঙালি জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে আলোকিত অধ্যায় হচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধ। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে এদেশের আপামর জনগন পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সোনার বাংলা বিনির্মাণে স্বাধীনতার স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে রচিত মহান সংবিধানের ১৬নং অনুচ্ছেদে নগর ও গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার মানের বৈষম্য ক্রমাগতভাবে দূর করার উদ্দেশ্যে কৃষি বিপ্লবের বিকাশ, গ্রামাঞ্চলে বৈদ্যুতিকরণের ব্যবস্থা, অন্যান্য শিল্পের বিকাশ এবং শিক্ষা, যোগযোগ ব্যবস্থা ও জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের আমূল রূপান্তর সাধনের জন্য রাষ্ট্র কর্তৃক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করা হয়। যার মাধ্যমে সোনার বাংলার রুপকল্প নবরুপ পায়।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রকৌশলী সম্মেলনে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণে বলেন যে, ‘বিদ্যুৎ ছাড়া কোন কাজ হয় না, কিন্তু দেশের জনসংখ্যা শতকরা ১৫ ভাগ লোক যে শহরের অধিবাসী সেখানে বিদ্যুৎ সরবরাহের অবস্থা থাকিলেও শতকরা ৮৫ জনের বাসস্থান গ্রামে বিদ্যুৎ নাই। গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ সরবরাহ করিতে হইবে। ইহার ফলে গ্রাম বাংলার সর্বক্ষেত্রে উন্নতি হইবে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও গ্রামে গ্রামে বিদ্যুৎ চালু করিতে পারিলে কয়েক বছরের মধ্যে আর বিদেশ হইতে খাদ্য আমদানী করিতে হইবে না’।
স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্সিয়াল অর্ডার ৫৯ (চঙ-৫৯) এর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের ৩১ মে ওয়াপদাকে দুই ভাগে বিভক্ত করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) এবং বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড গঠন করার মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতের এক নবদিগন্তের সূচনা করে। ফলশ্রুতিতে সমগ্র দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণের দায়িত্ব অর্পিত হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এর উপর। ১৯৭২-৭৫ এই সময়ে আশুগঞ্জ, ঘোড়াশাল ও সিদ্ধিরগঞ্জ তিনটি পাওয়ার হাব প্রতিষ্ঠা করা হয়। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনেতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যুতের অপরিসীম গুরুত্বের বিষয় বিবেচনা করে ১৯৭৭ সালের অক্টোবরে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) সৃষ্টি করা হয়।
স্বাধীনতা উত্তরকালে ৭৫ পরবর্তীতে জাতির জনকের নির্মম হত্যাকান্ডের পর স্বাধীনতা বিরোধী সরকার ক্ষমতায় থাকায় বিদ্যুৎ খাতের আশাব্যঞ্জক কোন অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়নি। সোনার বাংলা বির্নিমাণে দেশের সার্বিক অর্থনীতি তথা বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনা মুখ থুবড়ে পরে। অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা,দূর্নীতি, সিস্টেম লস বাড়তে থাকে।
বঙ্গবন্ধু থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা:
বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করে সে সময়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ছিল অত্যন্ত নাজুক। লোডশেড ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার।দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগে প্রধান বাধা হয়ে দাড়ায়। সে অবস্থা উত্তরণে শেখ হাসিনা সরকার বিদ্যুৎ খাত সংস্কার কর্মসূচীর আওতায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে বেসরকারি বিনিয়োগ সহ বিদ্যুৎ খাতের কাঠামোগত সংস্কার করে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতকে আলাদা করে সংস্থা ও কোম্পানি গঠন করা হয়। বিদ্যুৎ খাতের ন্যায় জ্বালানি খাতেও কাঠামোগত সংস্কার করে নানাবিধ সংস্থা ও কোম্পানি গঠন করা হয়।
১৯৯৬ থেেক ২০০১, এই সময়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নতেৃত্বে দেেশ অনকে বপ্লৈবকি পরর্বিতন সাধতি হয়। এই সময়ে বদি্যুৎ উৎপাদন ১,৬০০ থেেক ৪,৩০০ মগোওয়াটে উন্নীত হয়। ১৯৯৬ সালে শখে হাসনিার নতেৃত্বাধীন সরকার দায়ত্বি গ্রহণ করে বদি্যুৎ উৎপাদনে বসেরকারি বনিেিয়াগ আকৃষ্ট করার জন্য “চজওঠঅঞঊ ঝঊঈঞঙজ চঙডঊজ এঊঘঊজঅঞওঙঘ চঙখওঈণ ঙঋ ইঅঘএখঅউঊঝঐ” প্রণয়ন করনে। যার ফলশ্রুতেিত র্বতমানে বদি্যুৎ উৎপাদনে বসেরকারি অংশগ্রহণ প্রায় ৫০ ভাগ। তাছাড়া বদি্যুৎ শৃংখলা ফরিেিয় আনতে নানা র্কাযক্রম গ্রহন করা হয়।
২০০১-২০০৮ র্পযন্ত বিদ্যুতের অভাবে দেশের অর্থনীতি ছিল পর্যদুস্ত, শিল্প, বাণিজ্য ছিল স্থবির এবং জনজীবন ছিল বিপর্যস্ত। প্রতিদিন গড়ে ৮-১০ ঘন্টা লোডশেডিং এর কবলে মানুষের জীবন ছিল অসহনীয়। অথচ শুধুমাত্র ব্যবসায়িক ফায়দা লুটার জন্য মাইলের পর মাইল বিদ্যুতের খাম্বা আর তার লাগানো হয়েছিল।
২০০৯ সালে সারাবিশ্বে তখন ভয়াবহ মন্দা। এই ভয়াবহ অবস্থাকে চ্যালঞ্জে হিসেবে গ্রহন করেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিলেন দিন বদলের সনদ ২০২১ ‘রুপকল্প’। তিনি বিদ্যুৎ খাতের নির্বাচনী ইশতেহারে ঘোষণা দিলেন ২০২১ সালের মধ্যে সবার ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছানো হবে। বাংলাদশে হবে ডিজিটাল বাংলাদেশ। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবে বাংলাদেশ।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিকে দেয়া তাঁর প্রতিশ্রুতি রেখেছেন। ২০২১ এর অনেক আগেই বিদ্যুৎ এখন প্রায় সবার ঘরে পৌঁছেছে। বিদ্যুতের অগ্রযাত্রার ফলে আমরা বিশ্বের অনেক দেশকেই পিছনে ফেলে আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (গউএ) অর্জন করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর দুই মেয়াদে দেশ পরিচালনার সাফল্যের ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালে পূনরায় নির্বাচিত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে, যা বিগত ১০০ বছরেও হয়নি। সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব ও অগ্রাধিকার প্রদান করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয় বিবেচনায় রেখে জ্বালানি বহুমুখীকরণের জন্য গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পাশাপাশি কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি, ডুয়েল-ফুয়েল, পরমাণু বিদ্যুৎ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণসহ বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’ এ শ্লোগানকে সামনে রেখে সকলের জন্য নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন লক্ষমাত্রা অর্জিত হয়েছে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণকল্পে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে, যার সুফল আমরা ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছি। জানুয়ারি ২০০৯ হতে বর্তমান সময় পর্যন্ত ১৮,৫৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রীডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৪,৯৮২ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে এবং বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনসংখ্যা ৪৭ হতে ৯৯ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তাছাড়া ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণাধীন, ২ হাজার ৯৬১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২০টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়াধীন (খঙও এবং ঘঙঅ প্রদান করা হয়েছে) যেগুলো খুব শীঘ্রই কার্যক্রম শুরু করবে। তাছাড়া ৬৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৬টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো ১৫ হাজার ১৯ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৩ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পুরাতন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ, মেরামত বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে।
দেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও টেকসই জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের একক জ্বালানি হিসাবে গ্যাসের উপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ক্রমান্বয়ে জ্বালানি বহুমুখীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের বিকল্প হিসেবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বর্তমান সরকার নানাবিধ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এ লক্ষ্যে জমির প্রাপ্যতা, পরিবহন সুবিধা এবং লোড সেন্টার বিবেচনায় নিয়ে পায়রা, মহেশখালী ও মাতারবাড়ি এলাকাকে পাওয়ার হাব হিসাবে চিহ্নিত করে একাধিক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট মৈত্রী সুপার থার্মাল প্রজেক্ট, মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট আল্ট্রাসুপার ক্রিটিক্যাল কোল প্রজেক্ট এবং পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্প। গ্যাস ও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছাড়াও রাশিয়ার কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় রূপপুরে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ-চায়না পাওয়ার কো: লি: এর উদ্যোগে পায়রা ২৬৬০ মেগাওয়াট থার্মাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদন সফলভাবে শুরু হয়েছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদী মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা কার্যক্রমের আওতায় ২০৪১ সালের মধ্যে পার্শ্ববর্তী দেশসমূহ হতে প্রায় ৯০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ১,১৬০ মেগাওয়াট করা হচ্ছে । নেপাল হতে বিদ্যুৎ আমদানির লক্ষ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে এগজ এর নির্মিতব্য জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ভুটান হতে বিদ্যুৎ আমদানির বিষয়ে বাংলাদেশ, ভুটান এবং ভারতের মধ্যে একটি ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারক চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাক্ষরের অপেক্ষায় আছে। উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে শুধু বিদ্যুৎ আমদানি নয় বরং ঋতু বৈচিত্রকে কাজে লাগিয়ে উদ্বিত্ত বিদ্যুৎ রপ্তানী নিয়ে কাজ করছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যে সৌরবিদ্যুৎ ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর অধিক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এ লক্ষ্যে দালানের ছাদে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন জনপ্রিয় করার জন্য “নেট মিটারিং গাইডলাইন” প্রণয়ন করা হয়েছে এবং প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌরবিদ্যুতের প্যানেল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে।
বিগত একযুগে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করার ফলে বর্তমানে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ১২ হাজার ৬৯২ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৬ লক্ষ ০৩ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুতের সামগ্রিক সিস্টেম লস ২০০৮-০৯ অর্থ-বছরে ১৬.৮৫ শতাংশ হতে প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২০১৯-২০ অর্থ বছরে ১১.২৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ২৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৬ লক্ষ ৬০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। তাছাড়া আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের সকল উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে কাজ চলমান রয়েছে।
সরকার বিদ্যুৎ খাতে মানবসম্পদ উন্নয়নেও গুরুত্বারোপ করেছে। এ লক্ষ্যে ইধহমষধফবংয চড়বিৎ গধহধমবসবহঃ ওহংঃরঃঁঃব (ইচগও) গঠন করা হয়েছে এবং প্রতিষ্ঠানটি কার্যক্রম শুরু করেছে।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে বাংলাদেশ এখন বিদ্যুতের মান ও সেবার মান উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। অটোমেশন ও ডিজিটাল সেবা বৃদ্ধির মাধ্যমে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ ও গ্রাহক সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। গ্রাহকের জন্য স্মার্ট প্রি-পেইড মিটার, আন্ডার গ্রাউন্ড বিতরণ ব্যবস্থা সর্বোপরি স্মার্ট গ্রিড বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে।
বিদ্যুতায়নের ফলে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। এ সাফল্যের পিছনে বিদ্যুৎখাতের অবদান অনস্বীকার্য।
অর্থনীতিতে ক্রমাগতভাবে উঁচু প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পরেও মূল্যস্ফীতিকে রাখা হয়েছে সর্ম্পূণ নিয়ন্ত্রিত। বিশ্বের অনেক দেশকেই পিছনে ফেলে আমরা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (গউএ) র্অজন করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছি।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রূপকল্প ২০২১ এর ধারাবাহিকতায় ‘রূপকল্প ২০৪১’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আগামী দিনের সুখী ও সমৃদ্ধ উন্নত আলোকিত বাংলাদেশ রূপান্তরের নিমিত্তে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
সাফল্যের একযুগ, শতভাগ বিদ্যুৎ
লেখক : প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসাইন, মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়