সম্প্রতি নতুন মাদক ‘এলএসডি’ নিয়ে গ্রেপ্তার একজনের কাছে থেকে ‘ব্রাউনি’ বিষয় জেনে পিলে চমকে ওঠে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দায়িত্বশীলরা। এই গাঁজার কেক মাদকসেবীদের কাছে বেশ পরিচিতি পাওয়ার পরিস্থিতিতে চাঞ্চল্যকর ও উদ্বেগজনক তথ্য পাওয়া গেছে। ব্যাপক অনুসন্ধানের ভিত্তিতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) সম্প্রতি এমন একটি মাদকের চালান উদ্ধার করেছে। মাদকসেবীদের কাছে এটি ‘গাঁজার কেক’ বা ‘ব্রাউনি’ উভয় নামেই পরিচিত। এ চালান উদ্ধারের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ শিক্ষার্থীকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এই মাদক ব্যবসার জন্য ইন্টারনেটে ‘ইনস্টাগ্রামকে’ তারা বেছে নিয়েছিল। এই অ্যাপে একটি পেজ তৈরি করে চক্রটি দেদারছে গাঁজার কেক বিক্রি করে আসছিলো।
দেশে নতুন মাদক ‘এলএসডি’ সন্ধানের পর এবার আলোচনায় আসা ‘গাঁজার কেক’ বা ‘ব্রাউনি’ নিয়ে দেশে তোলপাড় চলছে। যে মাদকদ্রব্য দেখতে একেবারে ব্রাউনি কেকের মতোই। খেতেও প্রায় এক। খালি চোখে দেখে বোঝার উপায় নেই যে- ওটার সঙ্গে আসলে কী মেশানো আছে! গাঁজার নির্যাস থেকে নতুন উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে বানানো মাদক এটি। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এটিকে দেশে নতুন মাদক বললেও, শোনা যাচ্ছে- গত বেশ কয়েকবছর যাবত দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ-তরুণী শিক্ষার্থীদের কাছে এটি বেশ পুরোনোই! যা সিক্রেট গ্রুপের মাধ্যমে অনলাইনেও ব্যাপক বেচাকেনা হতো।
গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) বলছে, দেশে গাঁজার কেকের চালান এবারই প্রথম ধরা পড়েছে। গতকাল বুধবার (০৯ জুন) রাজধানীর মোহাম্মাদপুর ও পল্টন এলাকায় অভিযান চালিয়ে দেড় কেজি ওজনের ৪০টি গাঁজার কেক জব্দ করে ডিবির রমনা জোনাল টিম। অভিযানকালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের (এআইইউবি) ছাত্র কাফিল ওয়ারা রাফিদ, ধানমন্ডির অ্যাডভান্সড প্রফেশনালসে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টিং পড়ুয়া কাজী রিসালাত হোসেন এবং ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের (ইউডা) চারুকলা শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম সাইফকে গ্রেপ্তার করেছে ডিবির সংশ্লিষ্ট টিম। তাদের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মোহাম্মদপুর থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।
জানা গেছে, গ্রেপ্তারকৃত ২ গাঁজার কেক ব্যবসায়ীর মধ্যে রাফিদের বাবা ইদ্রিস আলী সিঙ্গাপুরে ব্যবসা করেন। মোহাম্মদপুরে তাদের নিজেদের বাড়ি রয়েছে। রিসালাতের বাবার নাম কাজী রওনাক হোসেন। তার দাদা প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক কাজী মোতাহার হোসেন। ইউডার চারুকলার শিক্ষার্থী সাইফ খিলাঁও সিপাহীবাগ এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বাস করে। রাফিদ পড়াশোনার পাশাপাশি ম্যারাথন দৌড়েও অংশ নিয়েছিল। এমনকি সাইফের মতো সে নিয়মিত সাইক্লিংও করে।
ডিবি জানায়, গাঁজার পাতা থেকে তরল নির্যাস বের করে তৈরি হয় এ কেক এবং অন্য সাধারণ কেকের মতোই খাওয়া যায়। এ কেক যারা খায় তারা বলছে, সিগারেটের খোসায় গাঁজা ভরে সেবনের চাইতে গাঁজার পাতার নির্যাসে তৈরি কেকে কয়েকগুণ বেশি আসক্তি হয় এবং খাওয়ার পর এর প্রতিক্রিয়া শুধু ভয়ঙ্করই নয়, মারাত্মক ক্ষতিকরও বটে।
সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের বিস্ময়করভাবে আত্মহননের ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে ভয়ঙ্কর মাদক লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইডের (এলএসডি) সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি’র বর্ণনা অনুযায়ী এলএসডির ভয়াল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় স্মৃতিকাতর ও কল্পনাপ্রবণ হয়ে পড়েন হাফিজুর এবং নিজের গলা ধারালো দা দিয়ে কেটে ফেলেন। এর ফলে ঘটনার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তার মৃত্যু হয়। এর পরই এলএসডি মাদকটি নিয়ে বিরাট এক প্রশ্ন দাঁড়ায় তদন্তকারীদের সামনে।
হাফিজুর রহমানের আত্মহননকাণ্ডের জেরে তার বন্ধু নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ ছাত্র সাদমান সাকিব ওরফে রূপল (২৫), আসহাব ওয়াদুদ ওরফে তুর্জ এবং ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র আদিব আশরাফকে (২৩) গ্রেপ্তার করে ডিবি। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় ২০০ ব্লট এলএসডি, মাদকের নিষিদ্ধ বাজারে যার মূল্য প্রায় ৬ লাখ টাকা।
তবে এলএসডি সেবনের ঘটনা বাংলাদেশে নতুন নয়। ২০১৯ সালে এলএসডিসহ ২ তরুণকে গ্রেপ্তার করেছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
সর্বশেষ, এই এলএসডির সন্ধানে অভিযানে নেমে বেরিয়ে আসে নতুন তথ্য, প্রথমবারের মতো গাঁজার কেকের বিষয়ে জানতে পারে ডিবি পুলিশ। ফেসবুকের একটি ক্লোজড গ্রুপের মাধ্যমে এলএসডি বিক্রি করা হতো। ওই গ্রুপ থেকেই প্রথম গাঁজার কেকের বিষয়ে জানতে পারে গ্রেপ্তার ৩ তরুণ। পরে তারা ইউটিউবে একটি টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে সেভাবে গাঁজার কেক তৈরি করেন। গ্রেপ্তার কাফিল ও রিসালাত গাঁজার কেক বিক্রির জন্য গড়ে ওঠা চক্রের অন্যতম হোতা আর সাইফ ছিলেন তাদের ডেলিভারিম্যান। মাদকসেবীরা অনলাইনে অর্ডার দিত, আর মাদককারবারিরা অর্ডারকৃত সেই মাদক বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসতো।
ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, ১ বছর ধরে গ্রুপটি গাঁজার কেক বিক্রি করে আসছিল। ইনস্টাগ্রামে তাদের পেজের নাম ছিল ‘ব্রাউনিগাইসবিডি’। গ্রেপ্তার অভিযান তদারকি করা ডিবির রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক আরটিভি নিউজকে বলেন, প্রাথমকি জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে।
আজ বৃহস্পতিবার (১০ জুন) গ্রেপ্তারকৃত ৩ জনকে আদালতে সোপর্দ করে ৭ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তারকৃতরা ডিবি পুলিশকে জানিয়েছে, তারা ৩ জনই মাদকাসক্ত। অন্যান্য মাদকের পাশাপাশি তারা নিয়মিত গাঁজা সেবন করে আসছে। বছর দেড়েক আগে ইউটিউবে দেখে তারা গাঁজার কেক বানানো শিখেছে। প্রথমে নিজেরা খেলেও পরে বন্ধুদের মধ্যেও এর ব্যপক চাহিদা তৈরি হয়। ব্যবসাটা শুরু করে তখনই।
গ্রেপ্তারকৃত রাফিদ ও রিসালাত জানিয়েছে, প্রতি পিস গাঁজার কেক তারা ৪ থেকে ৫ শ’ টাকায় বিক্রি করতো। প্রথম দিকে কাছের বন্ধুদের কাছে বিক্রি করলেও চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন ক্লোজ গ্রুপ তৈরি করে সেখানে বিক্রি করা শুরু করে। অর্ডার দিলে কখনও নিজে বা কখনও ডেলিভারিম্যানদের মাধ্যমে এসব মাদক পাঠানো হতো।
গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, উচ্চবিত্ত পরিবারের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়ারাই ইন্টারনেট ঘেঁটে মাদকের অভিনব সব ব্যবহার করছে। এর আগে এলএসডিসহ যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তারাও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থী। এলএসডিসহ গ্রেপ্তারকৃতদের একজনের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতেই গাঁজার কেক বিক্রি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়।