নির্বাচনের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা যে কোন রাজনৈতিক দলের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যময় ঘটনা। দেশের আপামর জনসাধারণের সামনে রাজনৈতিক দলের পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরবার প্রয়াসে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনকে রাজনৈতিক বোদ্ধারা গুরুত্বপূর্ণ অনুসঙ্গ হিসেবে মনে করে থাকেন। তাছাড়া রাজনৈতিক দলটির আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধের অবস্থানিক চরিত্রও প্রার্থী নির্বাচনের মাধ্যমে উঠে আসে। অধিকিন্তু প্রার্থী বাছাই এর ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের স্থান, কাল, ইস্যুভেদে দলের প্রত্যাশা ও চাহিদা অনুযায়ী প্রার্থী নির্বাচন করে থাকে। আবার প্রত্যেক রাজনৈতিক দল তাদের সুগঠিত গঠনতন্ত্র ও নিয়মকানুন মেনে চলে তাই প্রার্থী বাছাই এর ক্ষেত্রে দলের গঠনতন্ত্র সম্বন্ধে যেমনিভাবে অবগত হওয়া যায় ঠিক তেমনিভাবে দলটি গঠনতন্ত্র অনুসরণ করছে কিনা সেটিও জানা যায়।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই জনগণের অধিকার আদায়, স্বাধীনতা অর্জন, গণতান্রিযেক সংস্কৃতির রাজনৈতিক আবহ সৃষ্টিসহ প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম ও সামগ্রিক অর্জনের পেছনে দলটির অগ্রগণ্য ভূমিকা জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্যতার নমুনা রাখতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৭০ সনের স্বাধীনতা যুদ্ধ পূর্ববর্তী নির্বাচনে চরম সংকটকালিন সময়ে দলটি তৎকালিন পূর্বপাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে দলটির কার্যকর ভূমিকা বিশেষ করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় দলীয় নেতাদের আত্নত্যাগ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়েও যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ পুনর্গঠনে আওয়ামী লীগের ফলপ্রসূ দায়িত্বশীলতায় দেশ যখন সুস্থির অবস্থায় উপনীত ঠিক তখনি দেশী বিদেশী চক্রান্ত ও কূটজালে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করা হয়।
স্বাধীনতা সংগ্রাম প্রাপ্তিসহ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরবর্তী সময়েও অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে দলটি সোচ্চার ছিলো এবং এখনো রয়েছে। কিন্তু মাঝে মধ্যে বিভিন্ন মহলের কাছ থেকে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অবস্থান সম্বন্ধে নানা রকমের মন্তব্য দেখা যায়। তারই পরিপ্রেক্ষিতে এই নিবন্ধটি লেখার চেষ্টা করা হয়েছে বিশেষ করে দলটি পুরনো ঐতিহ্যের ধারাকে যথাযথভাবে লালন করতে পারছে কি? দলের সাংগঠনিক ভিত্তি, দলীয় কার্যক্রম, নেতাকর্মীদের তৎপরতা, দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে দলীয় কর্মীদের মতামতের প্রতিফলন, দলীয় প্রতিনিধির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পারস্পারিক সম্পর্কের বিশেষণ ইত্যাদি বিষয়গুলো একটি দলের সুসংহত অবস্থাকে নির্দেশ করে থাকে। তবে এটি একটি উল্লেখ করার মতো বিষয় যে, দলীয় ব্যানারে নির্বাচিত হওয়া প্রার্থীর সঙ্গে পরবর্তী সময়ে উক্ত দলের নেতাকর্মীদের পারস্পারিক যোগাযোগ তেমনটা সুখকর হয় না। সম্পর্কের টানাপোড়েনের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করে আসন্ন ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া উচিত, তাহলেই দলের ভেতরে গণতন্রেধ র অনুশীলন প্রত্যক্ষ করা যাবে।
প্রকৃত অবস্থান থেকে বলা যায়, দেশের জন্য এখনো যা কিছু ভাল হচ্ছে কিংবা ভাল করার সুযোগ রয়েছে তার সবটুকুই রাজনীতিবিদদের বিচক্ষণতার কারণেই হচ্ছে তথাপি রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছার উপরই নির্ভর করে কেননা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব মূলত রাজনীতিবিদদের হাতেই। তাই রাজনীতিকে বিশুদ্ধ করার কাজটি কেবল রাজনীতিবিদদের নয়, সকলের একাগ্রতা ও নিষ্ঠার প্রয়োজন এ স্বার্থকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার নিমিত্তে। পরিশুদ্ধ রাজনীতি পরিচালনা করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে যেখানে মেধাবী ছেলেমেয়েদের রাজনীতিতে আগ্রহ তৈরি হবে, রাজনীতিতে জবাবদিহীতা ও স্বচ্ছতার চর্চার পরিচায়ক ঘটবে পর্যায়ক্রমে। ফলশ্রুতিতে দেশের মধ্যে সুস্থ ধারার রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের বহি:প্রকাশ ঘটবে এবং দেশ সত্যিকারের সোনার বাংলায় পরিণত হবে।
বিশেষ করে দলগুলোর দলীয় কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনা করার সুব্যবস্থা সকল সরকারের সময়েই থাকতে হবে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোন দলের দলীয় কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। এটি মূলত সরকারের দায়িত্ব যার প্রেক্ষিতে প্রচলিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের দলীয় কার্যক্রম স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত করতে পারে। তৎপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার গণতান্রিপ্ক সংস্কৃতির ধারাকে বহাল রাখতে হবে যেখানে দলীয় কর্মীর মতামতের গুরুত্ব থাকে, কর্মীদের পছন্দের ভিত্তিতে মনোনয়ন প্রদানের রীতি চালু করা এবং কর্মীদের পছন্দের উপর ভিত্তি করেই নেতা নির্বাচনের আবহ তৈরি করা রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্ব।
আওয়ামী লীগ-কাউন্সিল
রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের অতিমাত্রায় অংশগ্রহণ, মনোনয়ন বাণিজ্য, উড়ে এসে জুড়ে বসা, দলীয় পরিচয়ের বাইরে মনোনয়ন প্রদান ইত্যাদি বিষয় কিন্তু রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাকে নষ্ট করে দেয়। তারই ডামাডোলে প্রকৃত রাজনৈতিক কর্মীদের মনোনয়ন দেওয়ার বিষয়টি অনেক সময় আড়ালেই থেকে যায়। করোনার মহাসংকটে আমরা দেখেছি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অনেককে সরকার কর্তৃক বহিস্কার করতে কেননা তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল, এ বিষয়গুলোও কিন্তু মনোনয়ন প্রদানের সময় বিবেচনায় নেওয়া উচিত হিসেবেই বিশ্লেষকগণ মনে করে থাকে।
আসন্ন ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কেমন প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া উচিত সে মর্মে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে যারা আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ব্যানারে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন তাদেরকে দ্বিতীয় মেয়াদে মনোনয়ন দেবার প্রাক্কালে বেশকিছু বিষয়কে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত: দলীয় চেয়ারম্যান থাকার পরেও অত্র ইউনিয়নের উন্নয়নের স্ট্যাটাস দেখা উচিত কেননা বর্তমান সরকার উন্নয়নের যে বারতা জনগণের সামনে নিয়ে এসেছে সে মোতাবেক ঐ ইউনিয়নে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে কিনা সেটি যাচাই করতে হবে। কারণ বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি স্থানিক পর্যায়ে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে কাঙ্খিত উন্নয়নের অন্তরায় হিসেবে আখ্যায়িত করে থাকে, এ যাত্রায় কিন্তু সে সুযোগ নেই। সরকার দলীয় চেয়ারম্যান থাকার পরেও যারা ইউনিয়ন পর্যায়ে কার্যত উন্নয়ন সাধন না করে ব্যক্তিগত উন্নতি করেছে তাদের বিষয়ে দলীয় হাইকমান্ড মনোনয়ন বঞ্চিত করে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। কারণ, ব্যক্তির দায় সংগঠন কখনো গ্রহণ করবে না।
দ্বিতীয়ত: পরিষদের চেয়ারম্যানের সাথে দলীয় নেতাকর্মীদের সম্পর্ক ও পরিষদ পরিচালনার ক্ষেত্রে দলীয় নেতাকর্মীদের সম্পৃক্ততা বিষয়গুলো নির্ধারক হিসেবে বিবেচনায় নিতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, জনপ্রতিনিধির সঙ্গে দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতিনিয়ত দূরত্ব তৈরি হচ্ছে এবং ভিন্ন দলের নেতাকর্মীর সঙ্গে প্রকাশ্য রাজনৈতিক সম্পর্ক দেখা যায় আওয়ামী লীগ দলীয় চেয়ারম্যানের। এহেন বিষয়গুলো তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দৃষ্টিগোচরে চলে আসে এবং ভোটের নির্বাচনে এ জাতীয় ইস্যুগুলো গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক শক্তি হিসেবে দেখা হয়। তৃতীয়ত: দলীয় নেতাকর্মী নয় কিন্তু সমর্থক যারা দলীয় প্রার্থীর পক্ষে জোরালোভাবে কাজ করেছে নি:স্বার্থভাবে তাঁদের সঙ্গে দলীয় চেয়ারম্যানের সম্পর্কের রসায়ন ইত্যাদি বিষয়গুলো আমলে নিয়ে প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রদান করা উচিত। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়; আওয়ামী লীগের সমর্থনকারী অনেকেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীর জন্য অর্থ খরচ করে এমনকি হুমকি দুমকিকে উপেক্ষা করে নির্বাচন পরিচালনার কাজে সহযোগিতা করে থাকে পরবর্তীতে জয়লাভের পর এ সকল নি:স্বার্থ মানুষের সাথে দলীয় চেয়ারম্যানের দূরত্ব কোনভাবে মানানসই নয়।
চতুর্থত: একটি সুনির্দিষ্ট সময় দলীয় আনুগত্যতার মিশেলে রাজনৈতিক চরিত্রকে স্পেসিফিকেশনের ভিত্তিতে দলীয় মনোনয়ন বরাদ্দ দেওয়া উচিত; উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জীবনের টানা ৩০ বছর কখনো কোন রাজনৈতিক কর্মকান্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় আওয়ামী লীগের একটি অঙ্গসংগঠনের নেতা হয়ে দলীয় মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার দৃশ্য অহরহ দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের রাজনীতিতে। বিষয়টি সুস্থ ধারার রাজনীতির জন্য কন্টকময় ও হতাশার। এমনো দেখা যায়, বংশে কেউ কখনো আওয়ামী লীগের পতাকাতলে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেনি কিন্তু আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতা হয়ে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নিচ্ছে। বর্তমান সময়ে নেতা হওয়ার প্রক্রিয়া সম্বন্ধে মোটামুটিভাবে সকলেই অবগত; কাজেই হুট করে নেতা হওয়া ব্যক্তিদেরকে কোনভাবেই আওয়ামী লীগের মতো সুপ্রাচীন দলের মনোনয়ন প্রদান করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। কেননা, সুসময়ের মাছিরা দুর্দিনে পরিচয় গোপন করে গর্তে লুকিয়ে থাকে, ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তনের পরবর্তী সময়ের ইতিহাসকে মূল্যায়ন করেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের ব্যানারে দলীয় মনোনয়ন প্রদান করা উচিত।
শেষত: এমন অনেক অভিযোগ শোনা যায় অর্থের বিনিময়ে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন বিকিকিনি হয়ে থাকে; আদৌ যদি এমন অভিযোগ সত্য হয়ে থাকে তাহলে সেটি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের অশনিসংকেত হিসেবে বলা যায়। কারণ, অর্থই যদি প্রধান ও মুখ্য মাধ্যম হিসেবে রাজনীতির মাঠে ভূমিকা রাখে তাহলে সেখানে রাজনীতির প্রয়োজন একেবারেই নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকে। সুতরাং নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের এ বিষয়টি নিশ্চায়ন করতে হবে যে, মনোনয়ন সংক্রান্ত কাজে অর্থের লেনদেনের সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেলে উক্ত ব্যক্তিকে দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় রাজনীতির মাঠ কলুষিত হয়ে যাবে, দিশেহারা হয়ে যাবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের বিকাশমান।
অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, রাজনীতিতে অর্থের ছড়াছড়ি সর্বত্র। পূর্বে বাংলাদেশে কিন্তু তেমনটা ছিলো না, দলীয় আনুগত্যতার মিশেলে দল অন্ত:প্রাণ কর্মীরা দলীয় কার্যক্রমে স্বেচ্ছায় অংশগ্রহণ করতেন এবং কর্মীরা দলীয় প্রয়োজনে নিজেদের মধ্য থেকে চাঁদা দিয়ে প্রয়োজন মেটাতেন। সেসব দৃশ্য এখন বিরল কেননা প্রত্যেকটি দলেই কর্মীদের খুব একটা সুদৃঢ় অবস্থান প্রত্যক্ষ করা যায় না। দলীয় বিভিন্ন প্রোগ্রামে লোকসমাগমের জন্য প্রচুর পরিমাণে অর্থ খরচ করতে হয় তা না হলে দলীয় প্রোগ্রামে লোক জড়ো হয় না। কাজেই বোঝা যাচ্ছে; রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে বর্তমান সামাজিক বাস্তবতায়; তবে এ চরম সত্যটি কেউ সহজে মুখ খুলে প্রকাশ করতে চায় না। এমন অনেক নেতা রয়েছে যারা মনে করেন দলীয় মনোনয়ন কোনক্রমে বাগিয়ে নিতে পারলেই ভোট কিনে নির্বাচনে জয়লাভ করতে পারবেন; এমন প্রার্থীদের দল থেকে বয়কট করা উচিত ভবিষ্যতের সুস্থ সুন্দর বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বার্থে। কারণ যে প্রার্থী টাকার বিনিময়ে নির্বাচনে মনোনয়ন সংগ্রহ করে এবং জনগণের ভোট কেনার পায়তারা করে থাকে আর যাই হোক না কেন সে প্রার্থীর দ্বারা জনগণের কোনরূপ উন্নয়ন সাধন হবে না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। এ কথা হলফ করে বলা যায়, এহেন প্রার্থীদের দ্বারা দলেরও বারোটা বাজতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।