হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা এবং সরকারি পরিপত্র জারি সত্ত্বেও মাদরাসাসহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ঘটনা ঘটছে। তবে অনুসন্ধান বলছে, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর তুলনায় মাদরাসাগুলোয় নির্যাতন ও মারধরের মাত্রা বেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ জন্য প্রয়োজন মানসিকতার পরিবর্তন এবং প্রচলিত চিন্তাধারা থেকে সরে আসা উচিত। আরটিভি নিউজ মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞ, মাদরাসার শিক্ষক, ছাত্র ও মানবাধিকার-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করেছে- কতিপয় মাদরাসা শিক্ষকদের হাতে কেনো শিক্ষার্থীদের নিষ্ঠুরভাবে মারধর ও নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে।
মঙ্গলবার (৯ মার্চ) চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে একটি মাদরাসায় শিশু শিক্ষার্থীকে বেদম মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে প্রশাসন ধরে নিয়ে আসলেও ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর পরিবারের অনুরোধে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। তবে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে মামলা দায়ের করেছে সরকার। একই রকমের ঘটনা ঘটে ময়মনসিংহের নান্দাইলের বালিয়াপাড়া মহল্লায়। সেখানে আমেনা মফিজ নুরুল কুরআন নূরানি ও হাফিজিয়া মাদরাসার শিক্ষক শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, পড়া ভুল করার কারণে তিনি এক ছাত্রকে পিটিয়েছেন। পরে নান্দাইলের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এরশাদ উদ্দীনের ভ্রাম্যমাণ আদালত আজ বুধবার (১০ মার্চ) দুপুরে ওই শিক্ষককে ৭ দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন। এর আগেও দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদরাসায় মারধর ও নির্যাতনের সংবাদ একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞের মতামত
এ বিষয়ে আরটিভি নিউজের সঙ্গে কথা হয় শিশু, কৈশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের। তিনি বলেন, মাদরাসার শিক্ষকরা অনেকটা অবহেলিত, তাদের আবেগগুলো অবদমনে থাকে। একইভাবে তারা কঠোর অনুশাসনের মধ্যে থাকে। যে কারণে তাদের আচরণ এমন হয়ে থাকে। এই কঠোর অনুশাসন থেকে যদি তাদের একটু ‘ওরিয়েন্টেশন’ করা যায় তাহলে এ ধরনের ঘটনা কমে আসবে। অন্যদিকে করপোরাল পানিশমেন্ট শিশুদের বিকাশে অন্তরায়, তাই এ ধরনের শাস্তি দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এই বিষয়গুলো যদি আমরা সংশ্লিষ্টদের বোঝাতে পারি তাহলে এমন পরিস্থিতির পরিবর্তন সম্ভব।
কারা এই ‘ওরিয়েন্টেশন’ করাতে পারবেন
যারা আমাদের সমাজের শিক্ষা বিজ্ঞানী আছেন, মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আছেন, শিশু মনোবিজ্ঞানী আছেন তারাই করবেন। এক কথায় শিক্ষা উন্নয়নের যারা কাজ করেন, এ কাজে তাদের সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের কঠোর নীতিমামলা থাকলেও তারা বাস্তবে প্রয়োগ করা হচ্ছে না। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। যা পরিবেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিতে হবে।
তথ্য বলছে, এই বেদম মারধর ও নির্যাতনের ঘটনা মাদরাসায় বেশি হচ্ছে। তবে, এর জন্য মোটেও মাদরাসায় শিক্ষা ব্যবস্থা দায়ী নয়। এমন ঘটনা কেবল সাধারণ স্কুল কলেজগুলোতে হচ্ছে না, ইংলিশ মিডিয়াম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের একটা ‘জেনারেল ওরিয়েন্টেশনের’ মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
ঢাকার সরকারি মাদাসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ্যের বক্তব্য
চলমান এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে আরটিভি নিউজ কথা বলে ঢাকার সরকারি মাদসা-ই-আলিয়ার অধ্যক্ষ প্রফেসর মোঃ আলমগীর রহমানের সঙ্গে।
তিনি আরটিভি নিউজকে বলেন, আমি প্রথমেই বলবো, আমাদের ‘মাইন্ড সেট’ আগে ঠিক করতে হবে। দেশের শিক্ষার্থীরা কেবল মাদরাসাতেই পড়াশোনা করে না, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে। অতএব নির্যাতন ও মারধরের ঘটনা কেবল মাদরাসাতেই ঘটছে না, বরং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেও ঘটছে। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে হবে। পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও দরকার।
শিক্ষার্থীর বক্তব্য
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি মাদরাসায় আলিমে (এইসএসসি সমমান) পড়াশোনা করছেন হাফেজ আব্দুর রহমান হাসান। এই শিক্ষার্থী আরটিভি নিউজকে বলেন, সামান্য দোষ বা ভুলের কারণে তুলনামূলক বেশি মারধর করার বিষয়টি ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছিলেন তিনি। স্মৃতিতে ঘেঁথে থাকা প্রচণ্ড মারধরের রেশে কখনো কখনো ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠতেন তিনি বা তার সহপাঠিরা। অতিরিক্ত কড়াকড়ি ও শিক্ষকের মারধর আতঙ্কে অনেক সময় সহপাঠিদের মাদরাসা ছেড়ে পালিয়ে যেতে দেখেছেন এই শিক্ষার্থী। হেফজ মাদরাসাগুলো বেশি কড়াকড়ি হয়ে থাকে, যেখানে অতিরিক্ত মারধরের ঘটনা ঘটে বলে জানান আব্দুর রহমান হাসান।
তবে অতিরিক্ত নয়, স্বাভাবিক মাত্রার মারধরকে সমর্থন করে এই শিক্ষার্থী বলেন, একেবারেই শাসন না করলে ছাত্ররা শিক্ষকের কথা শুনতে চায় না। অনেক সময় শিক্ষক তাদেরকে দুষ্টুমি করতে বারণ করলেও তারা তা মানে না। যে কারণে স্বাভাবিক মাত্রায় মারধর করলে মেনে নেয়া যায়, বিষয়টি ব্যালেন্স হয়।
পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নিতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে
সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, শিক্ষা মন্ত্রণায়লকে এ সংক্রান্তে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। শিক্ষকদের মানসিকতার পরিবর্তন এবং চিরচায়িত চিন্তা ভাবনা থেকে সরে আনতে প্রয়োজনীয় ‘ওরিয়েন্টশন’ কার্যক্রম হাতে নিতে হবে মন্ত্রণালয়কে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষকদের প্রতি নির্দেশনা জারি করতে হবে। এর ব্যাত্যয় ঘটলে, সে বিষয়ে কি পদক্ষেপ নেওয়া হবে সে বিষয়টিও স্পষ্ট করতে হবে। এছাড়া দুষ্টু শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে আনতে আধুনিক প্রক্রিয়ায় কি ধরনের ভূমিকা পালন করবেন শিক্ষকরা সেই বিষয়টি ভেবে দেখতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।
এই বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অবস্থান জানতে মুঠোফোনে শিক্ষা মন্ত্রী দীপু মনির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তা সম্ভব হয়নি। আজ বিকেল ৫ টা ৫৮ মিনিট থেকে শুরু করে ৬ টা ৭ মিনিট পর্যন্ত একাধিকবার শিক্ষামন্ত্রীর মুঠোফোনে কল দেওয়া হয়।
অভিযোগ করতে অভিভাবকের অবেহেলা
রহস্যজনক কারণে অভিযোগ করা থেকেও সরে আসতে দেখা যায় অভিভাবকদের। চট্টগ্রামের হাটহাজারিতে মাদরাসায় বেদম মারধরের ঘটনাটি এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। ওই মাদরাসার শিশু শিক্ষার্থীকে বেদম মারধর করেন ইয়াহইয়া নামের ওই শিক্ষক। যে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপরেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে ধরে নিয়ে আসে প্রশাসন। তবে ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে কোন প্রকার লিখিত অভিযোগ করতে চায়নি ছাত্রটির পরিবার। উল্টো তারা সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে ছেড়ে দিতে লিখিত আবেদন জানান। যার প্রেক্ষিতে শিক্ষককে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে, তার কৃতকর্মের জন্য তিনি ছাড় পাচ্ছেন না বলে আরটিভি নিউজকে জানিয়েছেন চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মাদ রুহুল আমীন। তিনি জানান, ওই শিক্ষক ইয়াহইয়ার বিরুদ্ধে সরকার বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছে।
আরও কয়েকটি ঘটনা
গত ১১ সেপ্টেম্বর তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাভারের আশুলিয়ার শ্রীপুরের মধুপুর জাবালে নূর মাদরসার ছাত্র শরিফুল ইসলাম (১৩) এবং মাহফুজুর রহমান (১৩) নামের দুই ছাত্রকে অন্য শিক্ষার্থীদের সামনে বেত দিয়ে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে শিক্ষক ইব্রাহিম।
গত ১৪ অক্টোবর রাতে সুনামগঞ্জ পৌর শহরের মোহাম্মদপুর এলাকায় একটি হেফজ মাদরাসায় হাত পা বেঁধে ঘরে আটকে শিক্ষার্থীকে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায়। শিক্ষকের মারধরে আহত মাদরাসা ছাত্রকে (১৫) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঘটনার পর পালিয়ে গিয়েছিলেন ওই শিক্ষক।
গত ১০ নভেম্বর রাতে বরগুনার আমতলী পৌর শহরের মহিলা কলেজ সড়কের কওমি মাদরাসার শিক্ষক হাফেজ মো. আবু বকরের নির্মম নির্যাতনে নুর জামাল নামের এক ছাত্রের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। বর্তমানে ওই ছাত্র আর উঠে দাঁড়াতে পারে না। কুঁজো হয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে তাকে।
গত ১৭ নভেম্বর সকালে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবো পৌরসভার মোগড়াকুল এলাকার হাদিউল কোরআন ইন্টারন্যাশনাল মাদসায় ইয়াসিন মিয়া (১১) নামে এক ছাত্রকে বেঁধে মারধরের অভিযোগ পাওয়া যায়। ছাত্রের বাবার অভিযোগ থেকে জানা যায়, শিক্ষকদের নির্দেশ অনুযায়ী মাদরাসার উন্নয়নকল্পে দীর্ঘদিন ধরে রাস্তার পাশে মাইকিং করে ছাত্ররা পথচারীদের কাছ থেকে দানের টাকা সংগ্রহ করে আসছিল। আজ সকালে মাইকিং শুরু করতে কিছুটা বিলম্ব হয়। পরে ইয়াসিন মিয়াকে শিক্ষক রাশেদের কক্ষে ডেকে নিয়ে বিলম্বের কারণ জানতে চাওয়া হয়। এক পর্যায়ে শিক্ষক রাশেদ ও আব্দুর রহিম মিলে হাত-পা বেঁধে ও মুখে কাপড় দিয়ে ইয়াসিনকে রড দিয়ে বেধড়ক মারধর করে। স্থানীয়রা ছুটে এসে তাকে উদ্ধার করে রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।