কথাগুলো বলছিলেন ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নায়ক, সেই সময়ের ডাকসু ভিপি এবং সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদ। বর্তমানে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ও বর্ষীয়ান জাতীয় এই নেতার ভাষায়, ‘বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া এত বড় গণজাগরণ বাংলাদেশের ইতিহাসে ঘটেনি, যেমনটি ঊনসত্তরের ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থানের দিন দেখা গিয়েছিল। ওই বছরের ২০ জানুয়ারি আসাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে যে আন্দোলন রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল, সেই আন্দোলনের সফল পরিণতি ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থান।’
তোফায়েল আহমেদ বলেন, এই গণঅভ্যুত্থানের ফলে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেওয়ার যে পরিকল্পনা আইয়ুব খান করেছিল তা বানচাল হয়ে যায়। ‘৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে নিঃশর্তভাবে ফাঁসির মঞ্চ থেকে মুক্ত করে আইয়ুব খানের পতন ঘটানো সম্ভব হয়। গণআন্দোলনের এই সাফল্যের পথ ধরে সত্তরের নির্বাচনে বাঙালির ঐতিহাসিক বিজয়, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে বাঙালির মুক্তির দিকনির্দেশনা, একাত্তরের ২৫ মার্চের গণহত্যার পর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা এবং মুক্তিকামী নিরস্ত্র বাঙালির সশস্ত্র জাতিতে পরিণত হয়ে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় লাভ। তাই এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান তাৎপর্যপূর্ণ এক মাইলফলক।
আজ ২৪ জানুয়ারি পালিত হতে যাচ্ছে সেই গৌরবময় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তি, সুবর্ণজয়ন্তী। ১৯৬৯ সালের এদিন বাঙালির স্বাধিকার আদায়সহ পাকিস্তানি স্বৈরশাসক জেনারেল আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মতিউর রহমানসহ পাঁচজন শহীদ হন।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি প্রায়-ঔপনিবেশিক শাসন, শোষণ ও বঞ্চনা থেকে বাঙালিকে মুক্ত করতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। এরপর স্বাধিকার আন্দোলনের গতি তীব্রতর হলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুকে বন্দি করে। এর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী ছাত্র-কৃষক-শ্রমিক-জনতার দুর্বার ও স্বতঃস্ম্ফূর্ত গণআন্দোলন শুরু হয়।
একপর্যায়ে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ১১ দফা দাবিতে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারি ঢাকায় হরতালের ডাক দেয়। এর আগে ২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান আসাদ শহীদ হওয়ায় গোটা পূর্ববাংলা এমনিতেই বিক্ষুব্ধ ও উত্তপ্ত ছিল। ২৪ জানুয়ারির হরতাল চলাকালে এই বিক্ষোভই গণবিক্ষোভ ও গণআন্দোলনে রূপ নেয়। সচিবালয়ের সামনে (আবদুল গণি রোড) শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে বকশীবাজার নবকুমার ইনস্টিটিউটের নবম শ্রেণির মেধাবী ছাত্র মতিউর রহমান রাজপথের চার সঙ্গীর সঙ্গে শহীদ হন। মতিউরদের এই আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলন দুর্বার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়। ডাকসুর তৎকালীন ভিপি ও ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে ছাত্রসমাজের পাশাপাশি রাজপথে নেমে আসে বিক্ষুব্ধ বাঙালি। গণঅভ্যুত্থানের মুখে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি নিজেও পদত্যাগে বাধ্য হন।
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেননের মতে, দীর্ঘ ৫০ বছর পরও ঊনসত্তরের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান এখনও প্রাসঙ্গিক। কেননা শ্রমিক-কৃষক ও সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির যে স্লোগানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছিল- সেই মুক্তি আজও অর্জিত হয়নি। বরং ধনী-গরিবের ফারাক আরও বেড়েছে, অর্থনৈতিক বৈষম্যও দিন দিন আরও প্রকট হয়ে উঠেছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে না পারলে ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, সেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে পারব না।
ঐতিহাসিক এই অধ্যায়ের আরেক সংগঠক বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের আগে আগেই পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসক আইয়ুব খান তার ‘উন্নয়নের এক দশক’ জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করে। তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতারা তাকে ‘আজীবন রাষ্ট্রপতি’ করার প্রস্তাবও করেছিল। কিন্তু গণঅভ্যুত্থান ও গণজাগরণের মুখে পতন ঘটেছিল তথাকথিত লৌহমানব আইয়ুব খানের। তবে ইতিহাস থেকে সবাই শিক্ষা নেয় না, এটাই দুর্ভাগ্য।
ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। পৃথক বাণীতে গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদনসহ তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন তারা।
এ ছাড়া বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে ‘৬৯-এর অভ্যুত্থানের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
আজকের কর্মসূচি :এ উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠন আজ সকাল ৮টায় রাজধানীর নবকুমার ইনস্টিটিউটে অভ্যুত্থানের কিশোর শহীদ মতিউর রহমান স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করবে। ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ৫০ বছর পালন জাতীয় কমিটির উদ্যোগে নবকুমার ইনস্টিটিউটে মতিউর রহমান স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা অর্পণ ছাড়াও বিকেল ৩টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।