নীতি নৈতিকতা বজায় রেখে যৌনতা স্বাভাবিক বিষয় হলেও ইন্টারনেটের মাধ্যমে হাতের নাগালে পাওয়া পর্ণগ্রাফি দেখে সেক্স ফ্যান্টাসিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে দেশের তরুণ-তরুণীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। এতেই যেনো তাদের বিশেষ আগ্রহ। যার ফলে ক্রমেই নীতি নৈতিকতার স্খলন ঘটছে। ধ্বংসের পথে নিমজ্জিত হচ্ছে তরুণ সমাজ। পর্ণ সাইটগুলো বন্ধ করা হয়েছে বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হলেও বাস্তব তার ভিন্ন চিত্র!
পর্ণ থেকে ‘ফরেন বডি’র ব্যবহারের একটি জ্বলন্ত উদাহরণ রাজধানী ঢাকার কলাবাগানে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ‘ও’ লেভেলের ছাত্রী আনুশকা নূর আমিনের মৃত্যু। যে ছাত্রীর বয়স মাত্র ১৭ বছর। এই মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে একের পর এক বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। বিশেষ করে আলোচনায় উঠে এসেছে বিপজ্জনক বিকৃত যৌনাচারে লিপ্ত হওয়ার অন্যতম উপাদান ‘ফরেন বডির’ কথা। যা সহজেই অনলাইন শপে এবং দেশের বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। ফরেন বডির বিষয়টি আলোচনায় আসায় আনুশকা ধর্ষণ ও হত্যা মামলার তদন্ত মোড় নিচ্ছে নতুনত্বের দিকে।
অভিযোগের তীর আনুশকার বয়ফ্রেন্ড ফারদিন ইফতেখার দিহানের দিকে। মামলায় অভিযোগ করা হচ্ছে, ‘প্রেমে প্রলুব্ধ’ করে বাসায় নিয়ে ‘বিক্রিত যৌনাচারের’ মাধ্যমে আনুশকাকে হত্যা করেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ‘এ’ লেভেলের ছাত্র ১৮ বছর বয়সী দিহান। এমন রহস্যময় পরিস্থিতিতে অভিযুক্তের বিশেষ অঙ্গের বাস্তবিক পরীক্ষার কথাও ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা। এর পরেই দৃশ্যমান আলামত, ভিক্টিমের রক্তক্ষরণের স্থানের ওই সময়ে পরিস্থিতি ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট মিলিয়ে তদন্তের অগ্রগতি অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আনুশকার যোনিপথ ও রেক্টামে ‘ফরেন বডি’ পুষ করায় মারাত্মক রক্তক্ষরণ হয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে সে। যা ‘সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি’ থেকেই করা হয়েছে।
মনস্তাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পর্ণ দেখতে দেখতে তরুণ-তরুণীরা অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে তারা ওইসব পর্ণে দেখানো ‘সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসির‘ স্বাদ নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে। নিজেদের মধ্যেই তা প্রয়োগের চেষ্টা করে। যার ফলে অপরিপক্ব তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মানসিক ও শারীরিক ভয়াবহ রকমের ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। এমন বিকৃত যৌনাচার মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সাইবার ক্রাইম ইউনিট থেকে বলা হচ্ছে, পর্ণ সাইটগুলো বন্ধ করতে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেকগুলো সাইট ব্লক করে দেওয়া হয়েছে। এই প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ইদানীং তরুণ বয়সীদের মধ্যে পর্ণোগ্রাফিতে আসক্তির সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। খুব ভয়াবহ আকারে বেড়ে যাচ্ছে এটি। স্মার্ট ফোনে ছোটো ছোটো বাচ্চা থেকে শুরু করে প্রাপ্ত বয়স্কদের মাঝেও আসক্তির মাত্রা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্কগুলো দিন দিন বেশ জটিলতার দিকে এগোচ্ছে। কখনো কখনো তা করুণ পরিণতিতে গিয়ে শেষ হচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, দিহানের বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেছে- দিহান পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত ছিল। যার প্রভাব আনুশকার উপর গিয়েও পড়ে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ যা বললেন:
পর্ণগ্রাফি থেকে সেক্স ফ্যান্টাসিতে ঝুঁকে পড়ার বিষয়ে আরটিভির সঙ্গে কথা হয় শিশু, কৈশোর ও পারিবারিক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদের। তিনি বলেন, পর্ণগ্রাফিতে রয়েছে সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি, যাকে বলা যায় ‘বিক্রিত যৌনাচার’। এই সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসিতে বিভিন্ন ‘ফরেন বডি’ বা ‘সেক্স টয়’ ব্যবহার করা হয়। এরমধ্যে কিছু রয়েছে মেশিনারি (ভাইব্রেটর) আবার কিছু রয়েছে নন মেশিনারি।
স্বাভাবিক যৌন উপভোগ থেকে মানুষ যখন হারিয়ে যায়, তখনই বিক্রিত যৌন উপভোগে উপনীত হয়, আবার যখন বিক্রিত যৌন উপভোগ আরও বাড়াতে চায় তখন বিকৃতির চরম অবস্থায় চলে যায়। এই চরম উপভোগের ভয়ঙ্কর ও ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রা হলো যৌনাঙ্গ আকৃতির ‘ফরেন বডি’ ব্যবহার করা।
এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ আরটিভি নিউজকে আরও বলেন, মানুষ পর্ণ দেখে ‘সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি’ শেখে এবং তা বাস্তব জীবনে প্রয়োগের চেষ্টা করে। কলাবাগানের ঘটনায় এর প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা সেটি তদন্তে বেরিয়ে আসবে। তবে মনোরোগ নিয়ে কাজ করার ফলে আমি, পর্ণ দেখে সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি বা বিক্রিত যৌনাচারে আসক্ত অনেক রোগীই পাচ্ছি। এর বড় একটি অংশ তরুণ বয়সী। আমাদের দেশে ক্রমেই এর বিস্তৃতি ঘটছে।
অধিকার বঞ্চিত তরুণ-তরুণীরা:
আমাদের দেশের তরুণ তরুণীরা তাদের স্বাভাবিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। যখন তাদের খেলাধুলা করা, গল্পগুজব করা, আড্ডা দেয়ার কথা ওই সময়টাতে তারা সুযোগ পেলেই অশ্লীল ভিডিও দেখছে বা ওই ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হচ্ছে। সুষ্ঠু বিনোদন ও ক্লাব কালচারের ব্যবস্থা না থাকাতেও কিশোররা নেশা বা পর্ণগ্রাফির দিকে ঝুঁকে পড়ছে।
প্রয়োজন সেক্স এডুকেশন:
কলাবাগানে ভিক্টিম আনুশকা এবং অভিযুক্ত দিহানের ঘটনাটি ঘটার অন্যতম কারন হতে পারে সেক্স এডুকেশনের অভাব। তাদের মধ্যে সেক্স এডুকেশন থাকলে হয়তো এমন পরিণতি হতো না। আনুশকাকে মৃত্যুর মুখে পতিত হতে হতো না। এই সেক্স এডুকেশন না থাকায় তারা সমাজের বেহাল ব্যবস্থার শিকার। যিনি মারা গেছেন, তিনি বিক্রিত যৌনাচারের শিকার হয়ে মারা গেছেন, স্বাভাবিক কিছু হলে তিনি মারা যেতেন না। উভয়ই অল্প বয়সী, মাত্র ১৭ এবং ১৮ বছর। সেক্স এডুকেশন না থাকায় তাদের স্বাভাবিক বিকাশ হয়নি। সে হিসেবে দিহানকে কেবল দায়ীই করা যাবে না, সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষাপটে তাকে ভিক্টিম হিসেবে দেখতে হবে। আমরা যদি স্কুলে কলেজে বিজ্ঞানসম্মত সেক্স এডুকেশনের ব্যবস্থা করতে পারতাম তাহলে এমন ধরনের দূর্ঘটনা হয়তো ঘটতো না। যেটা তারা পর্ণ ভিডিওতে দেখে তা যে বাস্তব নয়, সেক্স এডুকেশন থাকলে তারা তা জানতে পারতো।
পারিবারিক বন্ধন অটুট করতে হবে:
আমাদের পারিবারিক কাঠামোগুলোকে পুনঃগঠন করা প্রয়োজন। ক্রমেই পারিবারিক কাঠামোগুলো খণ্ডিত এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে, পিতামাতার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সন্তানদেরকে পিতা মাতারা কেবল প্রজেক্ট হিসেবে দেখছেন। যেমন- আমার সন্তান জিপিএ-৫ পাওয়া প্রজেক্ট, এ্যাওয়ার্ড পাওয়ার প্রজেক্ট, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রজেক্ট। এমন প্রজেক্টের থেকেও বেশি নজর দিতে হবে সন্তানকে তিনি কতোটুকো সময় দিচ্ছেন, সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কার সাথে মিশছে, ইন্টারনেটে কি ব্রাউজ করছে ইত্যাদি। এক কথায় সন্তানের সঙ্গে পিতার মাতার সুসম্পর্ক না থাকলে সন্তান বিপথগামী হবে।