ইয়াসিন আরাফাত : মুজিব বর্ষেই অর্থাৎ আগামী ১৭ মার্চের মধ্যে দেশ শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। স্বাধীনতার ৫০ বছর এবং মুজিব বর্ষ পূর্তিতে দেশের সব নাগরিক বিদ্যুৎ পাবেন বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এতে দেশের সব নাগরিককে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় আনার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অর্জিত হবে বর্তমান সরকারের।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সেবার আওতায় এসেছে জাতীয় গ্রিডের আওতায় থাকা সব গ্রাম ও পরিবার। শুধু বাকি রয়েছে গ্রিড এলাকার বাইরে থাকা কিছু বিচ্ছিন্ন দ্বীপাঞ্চল, দুর্গম পাহাড়ি এলাকা এবং দু’একটি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল এর ৩ লাখ ৭ হাজার ২৪৬ পরিবার। ওইসব এলাকা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে আলোকিত করার চেষ্টা চলছে। আগামী মার্চের মধ্যে এ পরিবারগুলোতেও বিদ্যুৎ পৌঁছে যাবে।
বিদ্যুৎ বিভাগ এবং বিতরণ কোম্পানিগুলো জানায়, গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ৯৮ শতাংশ গ্রাম-পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে। ৯৮ হাজার ৩১৯টি গ্রামের মধ্যে ৯৫ হাজার ২৪০টি গ্রাম শতভাগ বিদ্যুতায়িত করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা-কোম্পানিগুলো। এখন বাকি রয়েছে ৩ হাজার ৭৯টি গ্রাম। এ সবগুলো গ্রামই পার্বত্য, দ্বীপ এবং চরাঞ্চলের। এগুলোতে গ্রিড বিদ্যুৎ সরাসরি পৌঁছানো যায়নি। তাই বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি-বিশ্লেষণী সংস্থা পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, বিতরণ সংস্থাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গ্রাম বাকি রয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি)। এ সংস্থার আওতাধীন ২ হাজার ৫২ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছেনি। শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে সবচেয়ে বেশি মাইলফলক অর্জনকারী সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতায় ১ হাজার ১৪টি গ্রাম বাকি রয়েছে। রাজশাহী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোম্পানি ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির আওতায় ৯টি গ্রাম এবং উত্তর অঞ্চলের কোম্পানি নেসকোর আওতায় ১৭টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন হয়নি। ঢাকায় বিদ্যুৎ বিতরণে দায়িত্বরত দুই সংস্থা ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) এবং ঢাকা ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) আওতাধীন এলাকায় সব পরিবার বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছে।
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, শতভাগ বিদ্যুতায়নের পথে অনেক বাধা ছিল। এখনো আছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও নির্দেশনায় সেসব বাধা পেরিয়ে এখন সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে আমরা। বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে বিতরণ পর্যন্ত নিয়োজিত সবাই একটি দল হয়ে কাজ করার ফলাফল হলো, নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে এ অর্জন। চর এলাকায় বা অফগ্রিড এলাকায় বিদ্যুতায়ন কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও মুজিব বর্ষেই তা সম্পন্ন করা হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত একটি অনলাইন অনুষ্ঠানে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, শেখ হাসিনা সরকার উন্নয়নের ছোঁয়া দেশের সর্বত্র সমহারে পৌঁছে দিতে চায়। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান ২০১৫ অনুযায়ী ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের যৌথ চেষ্টায় বিদ্যুৎ উপাদন সক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। এরই মধ্যে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্পন্ন সাত জেলা এবং ২৮৮টি উপজেলা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। মুজিববর্ষের মধ্যে অবশিষ্ট উপজেলাগুলোতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ সম্পন্ন করার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বিদ্যুতের গ্রাহক সংখ্যা বর্তমানে ৩ কোটি ৮৭ লাখ এবং দেশের প্রায় ৯৮ শতাংশ জনগোষ্ঠী বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে। অবশিষ্ট ২ শতাংশ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশের অবস্থান প্রত্যন্ত অফগ্রিড এলাকাসমূহে। এ সব এলাকায় সাবমেরিন ক্যাবল এবং সোলার মিনিগ্রিডের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেয়ার কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
একই কার্যক্রমের আওতায় নেসকো প্রায় ১০ কোটি ১০ লক্ষ টাকা ব্যয় করে হাতিবান্ধা উপজেলার ১২টি চরে ৪৫২১ জন গ্রাহককে সোলার হোম সিস্টেম প্রদান করেছে। চরগুলো হলো উত্তর দাওয়াবাড়ি, দক্ষিণ দাওয়াবাড়ি, কিসমত নেহালি, পূর্ব দাওয়াবাড়ি, কর্দ্দা বিচন্ডই, পশ্চিম বিচন্ডই, উত্তর পারুলিয়া, দক্ষিণ পারুলিয়া, পূর্ব হলদিবাড়ি, পশ্চিম হলদিবাড়ি, পতিকাপাড়া ও সিনদোরোনা। ৬৫ ডচ (ওয়াট পিক) সক্ষমতার সোলার প্যানেলটি থেকে ৪টি ৩ ওয়াট এলইডি বাল্ব, ২টি ৮ ওয়াট ডিসি ফ্যান, মোবাইল চার্জার ও ১টি ডিভি সাপোর্ট করবে।
সর্বশেষ গত আগস্ট মাসে আরও ৩১ উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৮ জেলার ৩১টি উপজেলার শতভাগ বিদ্যুতায়নের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। প্রধানমন্ত্রী এর আগে ২৫৭টি উপজেলায় শতভাগ বিদ্যুতায়ন উদ্বোধন করেছেন। এই ৩১টি উপজেলা উদ্বোধনের পর মোট ২৮৮টি উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসে। এর ফলে দেশের ৯৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধা ভোগ করছে।
আরইবি’র আওতায় আর ১ হাজার ৫৯টি গ্রাম বিদ্যুৎ প্রদান বাকি রয়েছে কিন্তু সেখানেও কাজ চলছে পুরোদমে। এ বছরের মধ্যেই ওইসব এলাকা বিদ্যুতের আলোয় হাসবে। এই মুহূর্তে দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২৩ হাজার মেগাওয়াট। অথচ ২০০৮ সালেই উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৩ হাজার মেগাওয়াটের কিছুটা বেশি। মাত্র ১২ বছরে ১৭ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন এবং গ্রাহকসংখ্যা ১২ গুণ বৃদ্ধি করে এখন দেশের বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা ৩ কোটি ৮২ লাখ। আর ২ লাখ ৪০ হাজার গ্রাহকের কাছেই বিদ্যুৎ পৌছে দিতে পারলে সরকার দেশের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌছে দেয়ার যে লক্ষ্যমাত্রা ও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তা পূর্ণ হবে বলে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
তিনি আরও জানান, ২০০৯ সালের প্রথমভাগে দেশের ৫৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার বাইরে ছিল। তখন উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। গত এক যুগে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২২০ থেকে ৫১২ কিলোওয়াট ঘণ্টায় উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমেছে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। কৃষিসেচে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০০৯ সালে দেশে সেচ সংযোগ ছিল ২ লাখ ৩৪ হাজার। এখন সেটি ৩ লাখ ৬২ হাজার। শুধু জনপদ আলোকিত বা কৃষিতে উন্নতি নয়, অর্থনীতিতেও বড় পরিবর্তন এসেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নেয়া হয়েছে। এখনই উৎপাদিত হচ্ছে ২৩ হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট। ২০২১ সালের মধ্য ২৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে।
আরও জানা যায়, ২০১২ সালে শতভাগ বিদ্যুতায়নের যাত্রা শুরু হলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৬ সাল থেকেই ধাপে ধাপে শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসা উপজেলাগুলো উদ্বোধন করতে শুরু করেন। এতে শতভাগ বিদ্যুতায়নের এই কার্যক্রম ব্যপক গতি পায়। সারাদেশে মোট ৪৬১টি উপজেলার মধ্যে ইতিমধ্যে ৪১০টি উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় এসেছে। অফগ্রিডসহ সব এলাকায় বিদ্যুৎ দিতে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি)। সে হিসেবে মুজিব বর্ষের মধ্যেই দেশের সব উপজেলা শতভাগ বিদ্যুতায়নের আওতায় আসবে বলে আশা করছে আরইবি।
এছাড়া সাগরের তলদেশ দিয়ে সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলাকে জাতীয় গ্রিডের আওতায় আনা হয়েছে। কক্সবাজারের প্রায় ২১৫ বর্গকিলোমিটারের কুতুবদিয়া দ্বীপকেও পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে বিদ্যুতায়নের কাজ চলমান রয়েছে। নোয়াখালীর হাতিয়া ও নিঝুম দ্বীপের জন্যও একই ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। আইপিপিপির মাধ্যমে হাতিয়া দ্বীপে ৮ থেকে ১০ মেগাওয়াট তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুেকন্দ্র নির্মাণ করছে পিডিবি।
এ প্রসঙ্গে আরইবি’র সিস্টেম অপারেশন বিভাগের পরিচালক অঞ্জন কান্তি দাশ জানান, সম্প্রতি যেসব এলাকায় শতভাগ বিদ্যুতায়নের কাজ চলছে তারমধ্যে ৮০ থেকে ৯০ কাজ ভাগ শেষের পথে। কিন্তু তারপরও পুরোপুরি শতভাগ এলাকা বিদ্যুতায়ন হয়েছে, তা বলা যাবে না। কারণ আরইবির কিছু কিছু এলাকা আছে অফগ্রিড। সেই এলাকাগুলোতে বিদ্যুৎ দিতে আলাদা ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।