নতুন ক্লাসের সঙ্গে থাকবে পুরনো বই। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নতুন বইয়ের সঙ্গে আগের ক্লাসের পুরনো পাঠ্যপুস্তক ও নিয়ে আসতে হবে। করোনায় সরাসরি-মাধ্যমের শ্রেণি কাজ বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ‘শিখন-ঘাটতি’ সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে নতুন শ্রেণির জন্য আগের ক্লাসের পাঠ্যবইয়ের কিছু অংশ পড়া অপরিহার্য। সেই অংশটুকুই রুটিন করে শিক্ষার্থীদের নতুন পাঠের আগে পড়ানো হবে। এজন্যই পুরনো পাঠ্যবই সারা বছরই সঙ্গে রাখতে হবে।
এ ধরনের পাঠ নিতে হবে প্রাথমিক এবং নিু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের। এছাড়া আগামী ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের জন্যও তিন মাসের একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি হচ্ছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার পর সিলেবাসের ওপর প্রণীত ওই নতুন পরিকল্পনা নির্দেশনা আকারে শিক্ষকদের কাছে যাবে। তবে এবারে নবম ও একাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরতরা পুরো সিলেবাসই পড়বে। করোনা পরিস্থিতি প্রলম্বিত হওয়ার ওপর ভিত্তি করে পরে তাদের জন্য পরিকল্পনা তৈরি করা হবে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য (কারিকুলাম) অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান বলেন, একশ্রেণির লেখাপড়ার সঙ্গে পরের শ্রেণির একটি ধারাবাহিকতা আছে। বিশেষ করে কিছু বিষয় আছে যেটা আগের শ্রেণিতে না পড়লে পরের শ্রেণির পাঠ বোঝা ও অধ্যয়ন সম্ভব নয়। আমরা এমন অপরিহার্য পাঠ চিহ্নিত করার কাজ করছি। এরপর তা শিক্ষকের কাছে পৌঁছে দেয়া হবে। পাশাপাশি আগের পাঠ পড়ানোর বিষয়টি সাপ্তাহিক রুটিনে অন্তর্ভুক্ত করে দেয়া হবে। রুটিন দেখে শিক্ষক তা পড়াবেন।
তিনি আরও বলেন, ঘাটতি পূরণের জন্য আগের শ্রেণির পাঠ্যবই পড়ানো দরকার। তাই সেই বই সংরক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মাধ্যমে বার্তা পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, শিখন-ঘাটতি পূরণে সিলেবাসের প্রস্তাবিত ওই পরিকল্পনার নিু মাধ্যমিক স্তরের অংশের নাম দেয়া হয়েছে ‘ইনটিরিম (অন্তর্বর্তীকালীন) প্যাকেজ’। আর প্রাথমিক অংশের নাম দেয়া হয়েছে ‘রিম্যাডিয়াল (প্রতিকারমূলক) প্যাকেজ’। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার জন্য মোট তিনটি পরিকল্পনা তৈরি করছে এনসিটিবি। এগুলোর মধ্যে আছে প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দুটি এবং মাদ্রাসার একটি। ইতোমধ্যে প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিকের পরিকল্পনা তৈরির কাজ শেষ। উচ্চপর্যায়ের অনুমোদনের জন্য তা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। মাদ্রাসার পরিকল্পনা তৈরির কাজ চলছে। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার এ নিয়ে এনসিটিবিতে দিনব্যাপী কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, সাধারণত পাঠ্যবইয়ের সিলেবাস তৈরি হয় শিক্ষার্থীকে শ্রেণি ও বয়স অনুযায়ী শেখানো ও জ্ঞানের পথে পরিচালনার লক্ষ্যে। এর মধ্যে একটি অংশ থাকে বয়সভিত্তিক জ্ঞান ও যোগ্যতা অর্জনের লক্ষ্যে। এটির সঙ্গে অনেক সময় পরের শ্রেণির পাঠের সঙ্গে ধারাবাহিকতা নাও থাকতে পারে। আরেক ধরনের পাঠ প্রয়োজনের নিরিখে পরের শ্রেণিতেও থাকে। এই দুই ধরনের পাঠের ক্ষেত্রে পরের শ্রেণিতে পাঠদানের সময়ে শিক্ষক আগেরটি স্মরণ করিয়ে দেবেন। তৃতীয় ধরনের পাঠটি পরের শ্রেণির পাঠ বোঝার জন্য জরুরি। সেটি শিক্ষক ক্লাসে আগের বছরের পাঠ্যবই থেকে পড়িয়ে নেবেন।
জানা গেছে, এনসিটিবির পাঠ পরিকল্পনায় প্রত্যেক অধ্যয়ের জন্য ৭টি ক্লাস নির্ধারিত আছে। এর মধ্যে দুটি ক্লাস থাকবে আগের শ্রেণির পাঠ অধ্যয়নের জন্য। এনসিটিবির বিশেষজ্ঞ, শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের বিশেষজ্ঞ এবং প্রতি বিষয়ে দু’জন করে শ্রেণি শিক্ষকের একটি করে দল বিষয়ভিত্তিক এই পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, গণিতে সরল অঙ্ক করার আগে গুণন, ভাগ ইত্যাদি করতে হয়। এখন যে শিক্ষার্থী আগের শ্রেণিতে এটা করে আসেনি, পরের শ্রেণিতে আগে তাকে এটা শেখানো হবে। এভাবে অন্যান্য বিষয়েও অপরিহার্য দিকগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে। চিহ্নিত সব তথ্য বিষয়ভিত্তিক একীভূত করা হয়েছে। এখন তা ‘শিক্ষক গাইডে’ (টিজি) অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরপর তা প্রত্যেক বিদ্যালয়ে পৌঁছানো হবে। নিম্ন মাধ্যমিকে তিন শ্রেণির জন্য তিনটি আলাদা গাইড হবে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে দুই বছরের জন্য পাঠ্যবই তৈরি করা হয়। যারা নবম বা একাদশে পড়তে পারেনি তারা দশম বা দ্বাদশে পড়বে। যদি করোনা পরিস্থিতি প্রলম্বিত হয় তাহলে তাদের জন্যও আলাদা নির্দেশনা তৈরি করা হবে। অর্থাৎ আগামী জানুয়ারিতে যারা দশম শ্রেণিতে উঠছে তাদের জন্য গোটা বই-ই রাখা হচ্ছে পাঠের জন্য। আর যারা কয়েকদিন আগে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে তাদেরও গোটা বই পড়তে হবে।
তবে আগামী ফেব্রুয়ারি ও এপ্রিলে যাদের পরীক্ষা নির্ধারিত আছে তাদের সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে বলে ২৫ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়েছেন। সেদিন তিনি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘আগামী বছর যাদের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা, তাদের জন্য তিন মাসে শেষ করা যায়- এমন একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। এই সিলেবাসের আলোকে আমরা তাদের তিন মাস ক্লাস করাতে চাই। সে কারণে হয়তো এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা ২-১ মাস পিছিয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে ড. মশিউজ্জামান বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে সিলেবাস থেকে শিক্ষার্থীদের পাঠ কতটুকু কমছে বা নিু মাধ্যমিকে পরের শ্রেণিতে কতটুকু যাচ্ছে তা শতাংশে বলা সম্ভব নয়। তবে একটি সংক্ষিপ্ত ও অন্তর্বর্তীকালীন বিষয়ভিত্তিক পাঠ চিহ্নিত করা হয়েছে। উচ্চপর্যায়ের অনুমোদন শেষে তা প্রকাশ করা হবে।
তিনি আরও জানান, পঞ্চম শ্রেণির যারা ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হবে তাদের জন্যও আলাদা অন্তর্বর্তীকালীন পাঠ তৈরি করা হয়েছে। তাদেরও ষষ্ঠ শ্রেণিতে আগের শ্রেণির পাঠ্যবই নিয়ে আসতে হবে।
এদিকে প্রাথমিক স্তরের শিখন-ঘাটতি পূরণ সম্পর্কে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের (ডিপিই) মহাপরিচালক আলমগীর মুহম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, শিক্ষার্থীর ‘শিখন-পর্যায়’ এবং ‘শিখন-ঘাটতি’ উভয়ই আমরা মূল্যায়ন করব। এতে আগের শ্রেণিতে কতটুকু শিখেছে আর কী ঘাটতি আছে তা চিহ্নিত করা হচ্ছে। পরের শ্রেণিতে লেখাপড়া করার জন্য অত্যাবশ্যক কী শেখা বাকি আছে, বয়স ও শ্রেণি অনুযায়ী যা শেখা দরকার ছিল সেটা শিখতে পেরেছে কিনা ইত্যাদি নির্ণয় করা হচ্ছে। এরপর এর ভিত্তিতে একটি ‘রিম্যাডিয়াল প্যাকেজ’ (ঘাটতি দূর করার সিলেবাস) তৈরি করা হচ্ছে। সেটা পরের শ্রেণিতে ‘পুনঃপাঠ’ হিসেবে পড়ানো হবে।
তিনি আরও বলেন, একটা শ্রেণিতে সব শিক্ষার্থী সমান পারদর্শী থাকে না। যারা নানান কারণে কম শিখেছে তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নিতে শিক্ষকদের বলা হবে। এটা পরবর্তী শ্রেণিতে নিশ্চিত করা হবে।