বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় প্রধান নদীগুলোর পানি গতকাল শুক্রবারও কমেনি। বরং কোনো কোনো স্থানে পানি কিছুটা বেড়েছে। ফলে উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। কমেনি পানিবন্দী হয়ে থাকা কয়েক লাখ মানুষের দুর্ভোগ। ডুবে আছে হাজারো বাড়িঘর। তলিয়ে থেকে নষ্ট হচ্ছে বিস্তীর্ণ রোপা আমন, আউশ ও সবজিখেত। বন্ধ হয়ে গেছে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
এদিকে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বন্যা তথ্যকেন্দ্রের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির বরাত দিয়ে গতকাল বাসসের খবরে বলা হয়, আগামী ৭২ ঘণ্টায় গঙ্গা-পদ্মা ও ঢাকা শহরসংলগ্ন নদ-নদীর পানি আরও বাড়তে পারে। ব্রহ্মপুত্র ছাড়া সব প্রধান নদ-নদীর পানি বাড়ছে। নদ-নদীর ১৫টি স্থানের পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
কুড়িগ্রামে গতকাল ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপৎসীমার চার সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। জেলার ৫৩টি ইউনিয়নের দেড় লাখের বেশি বন্যার্ত মানুষ চরম কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন। প্রায় ১৫ হাজার হেক্টর জমির আউশ, আমন ও সবজিখেত এখনো তলিয়ে আছে পানিতে। এদিন তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১৬ সেন্টিমিটার বাড়ে। রাজারহাট উপজেলার ডাংরারহাট এলাকায় ভেঙে গেছে দুই কিলোমিটার তীররক্ষা বাঁধ। গত ২৪ ঘণ্টায় নদীতে বিলীন হয়েছে ২৫টি বাড়ি। একই এলাকার ৬ নম্বর স্পারেও ফাটল ধরেছে। ঠুঁটাপাইকর এলাকায় বাঁধের ১৭৫ মিটার স্লোপ (ঢাল) ভেঙে গেছে। এখানকার আশ্রয়ণ প্রকল্প, তৈয়ব খাঁ বাজার, দলদলিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয় ও কালিরহাট প্রাথমিক বিদ্যালয় পড়েছে ভাঙনের মুখে। অন্যদিকে, সদর উপজেলার যাত্রাপুর, ঘোগাদহ, পাঁচগাছি, মোগলবাসা, ভোগডাঙ্গা ও হলোখানা ইউনিয়নে নদীভাঙনে এ পর্যন্ত ৯২০টি বাড়ি বিলীন হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে সাত কিলোমিটার কাঁচা রাস্তা।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার দেড় হাজার পরিবার পানিবন্দী। গত তিন দিনে তলিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার হেক্টর রোপা আমনখেত। দুর্গতদের অনেকে সড়ক বাঁধ, উঁচু স্থান ও কলার ভেলায় ঠাঁই নিয়েছেন। ত্রাণ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তাঁরা। ডাকাতিয়া মেন্দা গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের গ্রামের তিন হাজার লোক পানিবন্দী। অথচ সরকারি-বেসরকারিভাবে আমরা কোনো সাহায্য পাইনি।’ মাদারগঞ্জ উপজেলায় পানিবন্দী দুই হাজার পরিবার। কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসলও রয়েছে পানির নিচে। বালিজুড়ী ইউনিয়নের নাদাগাড়ী এলাকায় একটি বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় আটটি গ্রামের মানুষ উপজেলা সদরে যাতায়াত করতে পারছেন না।
নীলফামারীতে তিস্তা গতকাল বিকেলে বিপৎসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১৫টি গ্রামের ১৫ সহস্রাধিক মানুষ পড়েছেন চরম ভোগান্তিতে। ডিমলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের কৃষক আবদুল লতিফ (৪৫) বলেন, সকালে ঘর থেকে পানি নামলেও দুপুরে আবার পানি বাড়তে শুরু করে। পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ খান বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্ত ৭০০ পরিবারের তালিকা দিয়ে পেয়েছি মাত্র ১০০ পরিবারের সহায়তা। যা দেওয়া হয়েছে তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।’
সিরাজগঞ্জে যমুনার পানি স্থিতিশীল থাকলেও করতোয়া, বড়াল, ইছামতী ও ফুলজোড় নদীর পানি কিছুটা বেড়েছে। যমুনা বিপৎসীমার ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দী। শুধু কাজিপুর উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে অন্তত এক লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। নদীভাঙনের মুখে পড়েছে বেলকুচি ও চৌহালী উপজেলার আগুরিয়া, রান্ধুনীবাড়ি, হরিনাথপুর, আগুরিয়াচর ও বিল মহিষা গ্রাম।
রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের ১৫টি গ্রাম থেকে পানি নেমে গেলেও বিস্তীর্ণ আমনখেত নষ্ট হওয়ার পথে। গতকাল উপজেলার মর্ণেয়া ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, আফজালপাড়া, মিলারপাড়া, নরসিং, রামদেব, কামদেব ও হেচানপাড়ার বসতবাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। কিন্তু আমনখেতগুলো রয়েছে ডুবে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবদুল হাকিম বলেন, এবারের বন্যার ধরন আলাদা। সকালে পানি নেই, কিন্তু দুপুরে আছে। বিকেলে নেই, তো রাতে আছে। কোলকোন্দ ইউপি চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, বৃহস্পতিবার নদীতে পানি বেড়ে উপজেলায় দ্বিতীয় দফায় বন্যা দেখা দেয়।
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দে গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মায় ৭ সেন্টিমিটার পানি বেড়ে বিপৎসীমার ১১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি বেড়ে ফরিদপুরের চরভদ্রাসন উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে নতুন করে। এসব এলাকার প্রায় সাড়ে ৬০০ পরিবার হয়ে পড়েছে পানিবন্দী। এই উপজেলার ঝাউকান্দা ইউপি চেয়ারম্যান ফরহাদ হোসেন মৃধা বলেন, তাঁর ইউনিয়নের উত্তর নবাবগঞ্জ, চরকালকাপুর, চৌধুরীডাঙ্গী ও শহর মোল্লার ডাঙ্গী এলাকায় নদীভাঙন শুরু হওয়ায় ২৫টি পরিবার অন্যত্র সরে গেছে। নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে অন্তত ২০ একর ফসলি ও সবজিখেত।
বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে গতকাল যমুনার পানি না বাড়লেও বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। এখানে যমুনা বিপৎসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি আরও বাড়লে এক কিলোমিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এখন পর্যন্ত চর ও নদীপাড়ের নয়টি ইউনিয়নের প্রায় দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছে। বন্ধ হয়ে গেছে অর্ধশত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সোহেল মোহাম্মদ সামস্উদ্দীন জানান, বন্যায় চার হাজার ১৭৫ হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এদিকে ধুনট উপজেলায় বাঙ্গালী নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে। ভান্ডারবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় তিন হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে রয়েছে।
ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টিতে ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার ভাংনামারী, সহনাটি, রামগোপালপুর, ডৌহাখলা, অচিন্তপুর, মাওহা ও গৌরীপুর ইউনিয়নের দুই থেকে তিন হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন তলিয়ে গেছে। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে এই ফসল পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
{প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: নিজস্ব প্রতিবেদক; কুড়িগ্রাম, রংপুর ও সিরাজগঞ্জ এবং বগুড়া ও ধুনট, নীলফামারী, সরিষাবাড়ী ও মাদারগঞ্জ (জামালপুর), গোয়ালন্দ (রাজবাড়ী) প্রতিনিধি}