বস্তির আগুনের রহস্যজট যেনো খুলতে চায় না কখনোই। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনগুলোও আলোর মুখ দেখে না। যে আগুনে নিম্ন আয়ের গরিব-দুঃখী মানুষগুলোর স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে কয়লায় রূপান্তরিত হয়। বস্তিগুলো থেকে ভেসে আসা লাশের গন্ধেও হুঁশ ফেরে না সংশ্লিষ্ট মহলের। প্রতিটি বস্তির আগুনের পেছনে রহস্য লুকিয়ে থাকার অভিযোগ থাকলেও সেই রহস্য জটও খুলে না কখনও। যদিও বস্তিবাসীরা প্রতিবারই আগুন লাগার পেছনে প্রভাবশালীদের জমি দখলের অভিযোগ করেন। কিন্তু তাদের সেই অভিযোগ আমলে নেয়া হয়েছে তারও কোনও নজির নেই। এসব অভিযোগের স্তুপগুলো কেবল বাতাসে ভেসে বেড়ায়, ঠাঁই পায় না তদন্ত প্রতিবেদনে।
গত ২৪ ঘণ্টায় রাজধানীর ‘মহাখালী’, ‘মিরপুর’ ও ‘মোহাম্মদপুরের’ ৩ বস্তিতে ভয়াবহ আগুনের ঘটেছে। এই ৩টি স্থানেরই নাম ‘ম’ আদ্যাক্ষরের। যার ফলে রহস্যজট আরও দৃঢ় হয়েছে। বস্তিতে ‘ম’ টার্গেটে পরিকল্পিত আগুন নয় তো এসব? এমন প্রশ্ন অনেকের মনে।
তিন আগুনে ফায়ার সার্ভিসের ৩ কমিটি
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন আরটিভি নিউজকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মহাখালী, মোহাম্মাদপুর এবং মিরপুরের বস্তিতে লাগা আগুনের ঘটনায় আমরা পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। আমরা সাধারণত কিসের কারণে এবং কিভাবে আগুন লেগেছে সেই কারণগুলো খুঁজে বের করে তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করে থাকি। তবে আমাদের এই তদন্ত প্রতিবেদনে কোনও ক্রিমিনাল অফেন্সের বিষয় আনা হয় না। কারণ ক্রিমিনাল অফেন্স খুঁজে বের করার দায়িত্ব অন্য সংস্থার।
ডিজি আরও বলেন, সাধারণত কোনও বস্তিতে আগুন লাগলে অভিযোগ উঠে ‘আগুন পরিকল্পিতভাবে লাগিয়ে’ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ক্রিমিনাল এ্যাক্টিভিটিস দেখার বিষয় আমাদের না। আমাদের দায়িত্ব হলো, কিভাবে এবং কি কারণে আগুন ছড়িয়ে পড়েছে সেটি বের করা।
দুর্ঘটনার আদলে বস্তিতে আগুন সন্দেহজনক
এই ৩টি বস্তির আগুন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আইন ও শালিস কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন আরটিভি নিউজকে বলেন, গত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পরপর ৩টি বস্তিতে আগুনের ঘটনায় সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে, মানবাধিকারকর্মীরা মনে করছে বস্তিগুলোতে ‘সুপরিকল্পিতভাবে’ একের পর এক আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। সাধারণত প্রভাবশালী মহল এমন কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে থাকে। এসব আগুন বস্তি উচ্ছেদের পরিকল্পনা হতে পারে। বস্তির জমি দখলমুক্ত করার অন্যতম হাতিয়ার হলো ‘আগুন লাগিয়ে’ দেওয়া। আমি মনে করছি, ঘটনাগুলো দ্রুত তদন্ত করে দেখা দরকার। যদি এসব আগুন ইচ্ছকৃতভাবে কেউ লাগিয়ে থাকে তাহলে তাকে দ্রুতই আইনে আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসীর অভিযোগে আমলে নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন এই মানবাধিকারকর্মী। তিনি বলেন, বাংলাদেশে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, বস্তিতে ভয়বহ আগুনের ঘটনা ঘটলেও, যাদের দিকে অভিযোগের আঙুল তাদের চিহ্নিত করা হয় না। এসব ঘটনার সঠিক তদন্ত হয় না। আর যদিও তদন্ত হয়, তাহলে দোষীদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে দুর্বলতার আশ্রয় নেওয়া হয়।
বস্তির আগুনের তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখার নজির নেই
বস্তির আগুনের তদন্ত প্রতিবেদন কখনও আলোর মুখ দেখার নজির নেই উল্লেখ করে মানবাধিকারকর্মী নূর খান লিটন বলেন, আমি এখন পর্যন্ত বস্তির আগুনের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটিগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখার নজির দেখিনি। যে প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কাউকে দোষী শনাক্ত করা হয়েছে বা তার কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সুপারিশ করা হয়েছে। উল্টো আমরা দেখেছি কোনও কোনও বস্তিতে আগুন লাগার পর ওই বস্তির জায়গায় অন্য কোনও স্থাপনা গড়ে তুলতে মরিয়া হয়ে উঠে ক্ষমতাশীন বা প্রভাবশালী মহলের কেউ কেউ।
বস্তিবাসীদের আবাস নিশ্চিত করা জরুরি, না হয় শঙ্কায় পড়বে উন্নয়ন
বস্তিতে বসবাস করা নাগরিকরাও দেশের অন্যান্য নাগরিকদের মতই অধিকার রাখে। সরকারকে এই বস্তিবাসীর আবাসস্থল নিশ্চিত করে করতে হবে। শহরের মধ্যে না হলেও শহরের আশপাশে কোথাও তাদের বসবাসের জন্য নির্ধারিত স্থান দিতে হবে। এখনই পরিকল্পনা না নিলে শহরে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যাবে। বস্তিতে বসবাস করা পোষাক শ্রমিক, রিকশাওয়ালা, গৃহকর্মীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন শ্রমের বিনিময়ে দেশের সার্বিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। তাই তাদের ছোট করে দেখার কিছু নেই। বস্তির এই অসহায় মানুষগুলোকে অবহেলা করা উচিৎ নয়, বরং তাদেরকে পরিকল্পিতভাবে আগলে রাখা জরুরি।
মহাখালীর ৭ তলা বস্তিতে আগুন, গায়ের কাপড় ছাড়া নেই কিছু আছিয়া পরিবারের
মহাখালী ৭ তলা বস্তিতে আগুন লাগে গত সোমবার দিনগত রাত পৌনে ১২ টার দিকে। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট আগুন নেভাতে কাজ করে। এই আগুনে নিঃস্ব হয়ে মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) খোলা আকাশের নিচে রাত কাটান সাততলা বস্তির ক্ষতিগ্রস্ত বাসিন্দারা। বুধবারও (২৫ নভেম্বর) হয়তো তাদেরকে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাতে হবে। কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা থেকে তাদের খাবারের ব্যবস্থা করা হলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনও সহায়তা পাননি বলে জানিয়েছেন বস্তিবাসী।
গৃহকর্মী বিধবা আছিয়া বেগম ২ ছেলে, ২ মেয়েকে নিয়ে এই বস্তির ছোট্ট একটি ঘরে ভাড়া থাকতেন। বুধবার বিকেলে তিনি জানান, ভয়াবহ আগুনে তার ঘরসহ ভেতরে থাকা সব মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, গায়ের কাপড় ছাড়া আর কিছুই নেই।
স্থানীয় বাসিন্দা সাব্বির আলম জানান, সাত তলা বস্তির প্রতিটি রুম এবং দোকান অবৈধ। এসব দোকান ও ঘর থেকে প্রতিমাসে ভাড়া, বিদ্যুৎ এবং গ্যাস বিল বাবদ কয়েক লাখ টাকা চাঁদা তুলতেন স্থানীয় কাউন্সিলর সমর্থক ও যুবলীগের কয়েকজন নেতা। এ নিয়ে তাদের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। ভুক্তভোগীরা মনে করছেন পরিকল্পিতভাবে এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছিরের মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কথা বলার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। তার ওয়ার্ড সচিব মো. শাহ আলম বলেন, কাউন্সিলর বাসায় বিশ্রামে আছেন। তবে তিনি নিয়মিত ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির খোঁজখবর রাখছেন।
মিরপুর বস্তিতে আগুন
২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসেও মিরপুরের এই বাউনিয়া বাঁধ পুকুর পাড় বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। ১১ মাসের মাথায় মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) দিনগত রাত ২টা ১০ মিনিটের দিকে এখানেই ফের আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের ১২টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কীভাবে আগুনের সূত্রপাত তা এখনও জানানো হয়নি। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি। ৮ বছর যাবত এই বস্তিতে থাকেন রিকশাচালক আসগর বেপারী। তিনি বলেন, দুই-এক বছর পরপরই এই বস্তিতে আগুন লাগে। কিন্তু এসব ঘটনার সুনির্দিষ্ট কারণ কখনোই জানা যায়নি।
তিনি বলেন, বস্তির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে কয়েকটি গ্রুপ আছে। তারা বিভিন্ন সময় বস্তির ঘর ভাড়া, পানি, গ্যাস এবং বিদ্যুৎ বিল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দ্বন্দ্ব জড়ান।
মিরপুরের আগুন নিয়ে সংসদ সদস্য যা বললেন
এদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর বস্তি পরিদর্শনের সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা সাংবাদিকদের বলেছেন, বস্তির ভেতর অনেকগুলো ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ ছিল। এসব গ্যারেজে অবৈধভাবে বৈদ্যুতিক সংযোগ নেয়া হয়েছে। কিভাবে আগুন লেগেছে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরাও বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। প্রাথমিকভাবে আমার মনে হচ্ছে, ব্যাটারিচালিত রিকশার গ্যারেজ থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে।
মোহাম্মদপুর বস্তিতে আগুন
মহাখালীর সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ১৫ ঘণ্টার মাথায় মোহাম্মদপুরে বাবর রোডের বিহারী পট্টি জহুরি মহল্লার পাশে বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিটের দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। এতে পুড়ে যায় শতাধিক ঘর। কিন্তু এই ঘটনার সূত্রপাতও উদঘাটন করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। সেখানকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, এই বস্তির অধিকাংশ লোকজন রাজধানীর আদাবর, মোহাম্মদপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুর এবং হাজারীবাগের বিভিন্ন গার্মেন্টস, ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। অগ্নিকাণ্ডের সময় তাদের অনেকেই বাসায় ছিলেন না। এ ঘটনার পেছনেও বস্তি দখলের দ্বন্দ্ব রয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
২০১৯ সালে ১৪৪ বস্তিতে আগুন
ফায়ার সার্ভিসের তথ্যানুযায়ী, গত বছর দেশে প্রায় ১৪৪টি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে শুধু রাজধানীতেই ২৫ বার বস্তিতে আগুন লাগে। এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছাড়িয়েছে শত কোটি টাকা। তবে চলতি বছরে দেশে কতগুলো বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে তা এখনও চুড়ান্তভাবে সমন্বয় করেনি ফায়ার সার্ভিস। তবে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরও বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নেহাত কম নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।