দলের ভিতরে অনুপ্রবেশ করা সুযোগসন্ধানী ‘কাউয়া’দের তালিকা করে তাদের লাগাম টেনে ধরতে সারাদেশে মাঠে নেমেছে আওয়ামী লীগ। এ ধরনের নেতা-কর্মীরা বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। এই কাউয়ারাই দলে ঘুণ ধরাচ্ছে, সর্বনাশ করছে- এ কথা এখন রাজনৈতিক অঙ্গণে সবার মুখে মুখে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের উঁচু-নিচু সব সাংগঠনিক কাঠামোতেই এখন সত্যিই ‘কাউয়াদের’ ছড়াছড়ি। লুটেপুটে খাওয়াই এদের টার্গেট। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একাধিক নেতা বিদ্রুপের সুরে বলেছেন, ‘কাউয়ারা এমন কোনো জিনিস নেই যাতে ঠোকর মারে না। আওয়ামী লীগে কাউয়াদের উপদ্রব দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরই শুধু নন, দেশের মানুষও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।’
জানা গেছে, আওয়ামী লীগে ‘কাউয়ার’ সন্ধান প্রথম পান আবদুস সামাদ আজাদ। সম্প্রতি ফেসবুকে এ কথাটি মনে করিয়ে দেন নেত্রকোনার আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মতিন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর এই ‘কাউয়া’দের অনেক দিন আওয়ামী লীগে দেখা মেলেনি। ২০০৮ সালের পর থেকে টানা ৯ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকায় তাদের তৎপরতা অনেক বেড়েছে। আওয়ামী লীগে ‘কাউয়া’ ঢুকেছে বলে সম্প্রতি বেশ কয়েকবার দাবী করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘তারা একাত্তরেও ছিল, এখনো আছে। ক্ষমতার সঙ্গে কাউয়া ঢুকে যায়। আর কিছু কিছু নেতা দল ভারী করার জন্য কাউয়াদের নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়। ওলামা লীগ, হাইব্রিড লীগ নানা নাম নিয়ে রাজনৈতিক দোকান খোলা হচ্ছে। এদের প্রতিহত করতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে যারা সংগঠনের নামে দোকান খুলে বসেছে, তাদের ধরে ধরে পুলিশে দিতে হবে।’ ওবায়দুল কাদের ‘কাউয়া’ নিয়ে নিয়ে কথা বলার পর দলের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছে। আগামী নির্বাচনের আগে এধরনের নেতাদের তালিকা করে তাদের নিস্ক্রিয় করে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য ইত্তেফাককে বলেন, ‘কাউয়া’ বলতে দলের সাধারণ সম্পাদক হাইব্রিডদেরকেই বুঝিয়েছেন। এসব নেতা সময় বুঝে নিজের স্বার্থ উদ্ধারে কাজ করছে। এদের তালিকা প্রস্তুত করার কাজ চলছে। এই নেতাদের গত ৮ বছরে দলের জন্য কি কি অবদান এবং নিজের আর্থ-সামাজিক অবস্থার কী উন্নয়ন হয়েছে, অথবা তার পরিবারের সদস্যরা রাজনৈতিক সুবিধা নিয়ে কী কী সুবিধা আদায় করেছেন সে বিষয়গুলোও প্রতিবেদনে উল্লেখ থাকবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আওয়ামী লীগে এখন রাজনৈতিক দোকানের ছড়াছড়ি। জীবনে আওয়ামী লীগের আদর্শের রাজনীতি করেননি তারাই দল ক্ষমতায় আসার পর ভুঁইফোড় সংগঠন গড়ে তুলেছেন। এরা এখন দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও ত্যাগী নেতাদের ওপর ছড়ি ঘুরাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দলের শীর্ষ কয়েকজন নেতা নিজ এলাকায় ভিত্তি মজবুত করতে জামায়াত-শিবির ও বিএনপির নেতাদের ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগে বরণ করে নেন। এছাড়া বিভিন্ন বাম সংগঠনের নেতারাও আওয়ামী লীগে যোগদান করে। এরা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, দখলসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা করছেন না। এদের দুর্ব্যবহারে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতারা ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্য ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, শুধু বললেই হবে না। এদের লাগাম টেনে ধরতে হবে।
আলোচিত শতাধিক ‘কাউয়া’ সংগঠন
কাউয়া (ভুঁইফোঁড়) সংগঠনের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বরং ক্রমন্বয়ে বাড়ছে এসব সংগঠনের সংখ্যা। পেছনে ‘লীগ’ শব্দ ব্যবহার ছাড়াও আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেল, সজীব ওয়াজেদ জয়সহ বিভিন্ন নামে শতাধিক ভুঁইফোঁড় সংগঠন গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে অনুমোদন না থাকলেও এসব সংগঠনের নেতারা আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে বিভিন্ন দফতরে অনৈতিক সুবিধা আদায় ও নিজ নিজ এলাকায় ব্যাপক চাঁদাবাজি করে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ‘আওয়ামী’, ‘লীগ’, ‘নৌকা’ ও ‘ডিজিটাল’ শব্দ ব্যবহার করে গড়ে তোলা সংগঠনগুলো হচ্ছে আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী তরুণ লীগ, আওয়ামী মুক্তিযোদ্ধা লীগ, আওয়ামী লীগ সমর্থক, আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ প্রজন্ম লীগ, আওয়ামী হকার্স লীগ, আওয়ামী যুব হকার্স লীগ, আওয়ামী ছিন্নমূল হকার্স লীগ, আওয়ামী সমবায় লীগ, আওয়ামী শিশু যুব সাংস্কৃতিক জোট, আওয়ামী পরিবহন শ্রমিক লীগ, আওয়ামী তৃণমূল লীগ, আওয়ামী যুব স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী শিশু-কিশোর লীগ, আওয়ামী অভিভাবক লীগ, আওয়ামী কর্মজীবী লীগ, আওয়ামী প্রচার লীগ, আওয়ামী প্রচার ও প্রকাশনা লীগ, আওয়ামী পর্যটন লীগ, আওয়ামী নবীন লীগ, আওয়ামী স্বাধীনতা লীগ, আওয়ামী বাস্তুহারা লীগ, আওয়ামী ইয়াং বাংলা লীগ, আওয়ামী সৈনিক প্লাটুন, মুক্তিযোদ্ধা লীগ, মুক্তিযোদ্ধা তরুণ লীগ, মুক্তিযোদ্ধা জনতা লীগ, তরীকত লীগ, চলচ্চিত্র লীগ, মত্স্যজীবী লীগ, ছিন্নমূল মত্স্যজীবী লীগ, ক্ষুদ্র মত্স্যজীবী লীগ, রিকশা মালিক লীগ, রিকশা মালিক-শ্রমিক ঐক্য লীগ, রিকশা-ভ্যান শ্রমিক লীগ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্মচারী লীগ, দেশীয় চিকিত্সক লীগ, নৌকার মাঝি শ্রমিক লীগ, ঘাট শ্রমিক লীগ, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী লীগ, নৌকা প্রজন্ম, নৌকা সমর্থক গোষ্ঠী, নৌকার নতুন প্রজন্ম, ডিজিটাল আওয়ামী লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী প্রজন্ম লীগ, ডিজিটাল আওয়ামী ওলামা লীগ, ডিজিটাল ছাত্রলীগ, ডিজিটাল বাংলাদেশ, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ প্রভৃতি।
বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নাম ব্যবহার করে গড়ে তোলা সংগঠনগুলো হলো, বঙ্গবন্ধু আদর্শ বাস্তবায়ন সংসদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ বাস্তবায়ন লীগ, বঙ্গবন্ধু লেখক লীগ, বঙ্গবন্ধু গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও চেতনা গবেষণা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু আদর্শ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু শিশু একাডেমি, বঙ্গবন্ধু আইনজীবী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু ডিপ্লোমা প্রকৌশলী পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু যুব পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জাতীয় লেখক পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, বঙ্গবন্ধু বাস্তুহারা লীগ, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী হকার্স ফেডারেশন, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা বাস্তবায়ন পরিষদ, বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা লীগ, বঙ্গবন্ধু গ্রাম ডাক্তার পরিষদ, বঙ্গবন্ধুর সৈনিক, বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগ, বঙ্গবন্ধু নাগরিক সংহতি পরিষদ, চেতনায় মুজিব, আমরা মুজিব সেনা, বঙ্গমাতা পরিষদ, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব পরিষদ, জননেত্রীর সৈনিক, জননেত্রী পরিষদ, দেশরত্ন পরিষদ, রাসেল মেমোরিয়াল একাডেমি, শেখ রাসেল শিশু সংসদ, শেখ রাসেল শিশু পরিষদ, সজীব ওয়াজেদ জয় পরিষদ প্রভৃতি।
মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের নাম নিয়ে গড়ে ওঠা সংগঠনগুলোর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ সমাজকল্যাণ যুব সংঘ, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, মুক্তিযুদ্ধ ও গণমুক্তি আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পরিবার কল্যাণ পরিষদ, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী, স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি প্রতিরোধ কমিটি, প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন, মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা পুনর্বাসন সংস্থা, আমরা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম, স্বাধীনতা হোমিওপ্যাথিক চিকিত্সক পরিষদ, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পরিষদ প্রভৃতি।
আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্রের ২৫ (১) ধারা অনুযায়ী, সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা পাচ্ছে মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, আওয়ামী যুবলীগ, আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ এবং যুব মহিলা লীগ। আর নিজেদের গঠনতন্ত্র অনুসরণের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে জাতীয় শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ। অর্থাত্ এই নয়টি সংগঠনের বাইরে আওয়ামী লীগ ঘরাণার রাজনীতিতে কোন সংগঠন নেই।