ফলে ত্যাগী, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, দলের প্রতি নিবেদিত, পদবঞ্চিত-এমন নেতারা এখন বেশ চাঙ্গা।
তাদের ধারণা, দল ও সরকারে চলমান শুদ্ধি অভিযানের ফলে প্রকৃত নেতারা মূল্যায়িত হবেন। কালোটাকা, পেশিশক্তি, ‘বড়ভাই’, গ্রুপবাজির মাধ্যমে পদপ্রাপ্তির সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ হবে।
অন্যদিকে পদ হারানোর শঙ্কায় আছেন-টেন্ডার ও চাঁদাবাজ, অনুপ্রবেশকারী, দলের ভেতর অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টিকারী, বিভিন্ন দুর্নীতিবজসহ ক্যাসিনো পরিচালনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত নেতারা।
কারণ এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জিরো টলারেন্স (শূন্য সহিষ্ণুতা)’ ঘোষণা করেছেন। তা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা।
ইতিমধ্যেই সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে অব্যাহতি দেয়ার পাশাপাশি নিষ্ক্রিয় করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, অপকর্মের জন্য এদের অনেকের বিরুদ্ধে নেয়া হয়েছে আইনানুগ ব্যবস্থাও।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্লাহ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে কাউন্সিল নিয়ে উৎসব বইছে। মূল দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে সহযোগী সংগঠন যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষকলীগ, ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন শ্রমিক লীগের কাউন্সিল হচ্ছে। জাতীয় সম্মেলনের আগে তৃণমূল গোছাচ্ছে সব সংগঠন। ফলে সবাই এখন কাউন্সিল নিয়ে ব্যস্ত। তিনি বলেন, কাউন্সিলের মাধ্যমে সব পর্যায়ে এবার স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতা বেরিয়ে আসবে। বিতর্কিতরা বাদ পড়বেন।
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলের জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে ইতিমধ্যে দলের সবস্তরের নেতাদের ওপর একাধিক জরিপ চালানো হয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন মাধ্যমে পরিচালিত এসব জরিপের বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত দলের হাইকমান্ডের কাছে জমা পড়েছে।
যেসব নেতা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত তাদের রাখা হয়েছে নজরদারিতে। এসব দুর্নীতিবাজ নেতা আওয়ামী লীগের নতুন কমিটিতে স্থান তো পাবেনই না, উল্টো তাদের বিরুদ্ধে নেয়া হবে সব ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা।
অন্যদিকে জরিপে ত্যাগী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির নেতাদের নাম উঠে এসেছে, তাদের একটি পৃথক তালিকা দলীয় সভাপতির কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশাপাশি তৃণমূলের অনেক পরীক্ষিত নেতার নাম অন্তর্ভুক্ত আছে। যেখানে রয়েছে অনেক নতুন মুখও।
এ তালিকায় স্থান পাওয়া নেতাদের ওপর এই মুহূর্তে চলছে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তাদের মধ্য থেকেই কাউন্সিলের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের আগামী নেতৃত্ব তুলে আনা হবে।
আওয়ামী লীগের আগামী নেতৃত্ব প্রসঙ্গে দলটির সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বুধবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘নিজের ঘরের মধ্য থেকে প্রধানমন্ত্রী শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। যারা টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও মাদকের সঙ্গে যুক্ত থাকবে, তাদের কেউ ছাড় পাবে না।
এতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কোনো নেতাও যদি জড়িত থাকেন তারাও কিন্তু নজরদারিতে আছেন। সময়মতো প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নেত্রী বলেছেন, জনগণের স্বার্থে যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে আমি প্রস্তুত। জনগণের স্বার্থে মানুষের স্বার্থে আমার দলের যে কেউ অপকর্ম করবে সেটা আমি বরদাশত করব না, সহ্য করব না।’
আওয়ামী লীগকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে জানিয়ে ওবায়দুল কাদের আরও বলেছেন, আমরা আওয়ামী লীগকে একটি নতুন মডেলে সাজাতে যাচ্ছি। নেত্রী আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, কোনো বিতর্কিত ব্যক্তিকে দলে স্থান দেয়া যাবে না।
অনুপ্রবেশের বিষয়ে নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেন, নিজেদের পকেট ভারি করার জন্য, নিজেদের সমর্থক বাড়ানোর জন্য দলে অনুপ্রবেশ করাবেন না। দুষ্ট গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভালো।
আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল। পাশাপাশি নভেম্বরের মধ্যে শেষ হচ্ছে মেয়াদোত্তীর্ণ সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম চার সংগঠনের সম্মেলন।
১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সম্পন্ন হবে আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা কাউন্সিল। এ লক্ষ্যে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন তৃণমূলে।
বর্ধিত সভা ও কাউন্সিল করছেন তারা। জেলা-উপজেলায় গঠন করছেন নতুন নেতৃত্ব। সব মিলে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত কাউন্সিল ঘিরে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিরাজ করছে আনন্দ-উল্লাস।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ ও পদপ্রত্যাশী বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দলে ও সরকারে শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ত্যাগী ও বঞ্চিত নেতারা নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন।
দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা ও তা বাস্তবায়নের ফলে পদপ্রত্যার্শী হয়ে উঠছেন অনেকে। শঙ্কার আবর্তে জর্জরিত বিতর্কিতরা যখন নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছেন, তখন নতুনদের এই উচ্ছ্বাস ও দলীয় কার্যালয়ে নেতাকর্মীদের শোডাউন ত্যাগীদের আশার সঞ্চার করছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, চলমান শুদ্ধি অভিযানের ফলে দলে এক ধরনের যে মেরুকরণ ছিল তা স্পষ্টত উঠে গেছে।
তারা আরও বলেন, শুদ্ধি অভিযানে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে একটি গুমোট পরিবেশ সৃষ্টি হলেও এখানে প্রকৃত নেতারা আনন্দিত। তাদের ভেতর উচ্ছ্বাসও আছে। তবে শুদ্ধি অভিযানের কারণে বিতর্কিত নেতাদের এড়িয়ে চলছেন সাধারণ নেতাকর্মী। তাদের ধারণা এই নেতাদের আগামী কমিটিতে জায়গা নেই।
এদিকে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রাঙ্গণ, ধানমণ্ডি ৩-এ প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক কার্যালয় ও তৎসংলগ্ন নির্বাচনী কার্যালয় এখন নেতাকর্মীদের উপচেপড়া ভিড়। দুপুর থেকে রাত অবধি চলে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের শোডাউন।
এখানেই শেষ নয়, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা, নিজস্ব কার্যালয় দলীয় নেতাকর্মীদের পদচারণায় গমগম করছে। রাত ২টা-৩টা পর্যন্ত এসব নেতার বাসা, কার্যালয়ের সামনে শত শত মোটরসাইকেল ও নেতাকর্মীদের আনাগোনা চোখে পড়ার মতো।
বিগত এক সপ্তাহ আওয়ামী লীগের কার্যালয়, কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা ও তাদের নিজস্ব কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, বিকাল গড়ালেই খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে দলীয় কার্যালয়ে আসেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতারা। নিজেদের প্রদর্শনের চেষ্টা থাকে অনেক নেতার। কর্মীবেষ্টিত অনেক নেতা কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ শেষে দোয়া নিচ্ছেন।
সন্ধ্যা গড়ালেই আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডি কার্যালয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। তাদের টার্গেট- স্থানীয় সম্মেলন নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আলোচনা, নিজের পদ-পদবি ঠিক রাখতে কেন্দ্রীয় নেতাদের অনুকম্পা পাওয়া।