রাজধানীর মতিঝিলে নিজ অফিসের সামনে মোহাম্মদ সুলতান আহমেদ (৪৫) নামে এক ঠিকাদারকে দিনেদুপুরে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে মতিঝিলের আরামবাগ কালভার্ট রোডের ১০/৩ নম্বরের মকবুল প্লাজার সামনে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সুলতান পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার। তিনি ঢাকা মহানগর যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলেও জানিয়েছেন স্থানীয়রা। এদিকে বৃহস্পতিবার সকালে কাফরুল এলাকা থেকে মিজানুর রহমান (২৬) নামে এক যুবলীগ কর্মীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীদের তথ্যমতে, সুলতানকে হত্যায় সরাসরি অংশ নেয় দুই যুবক। আগেও একাধিকবার তারা হত্যার চেষ্টা করে। পুলিশের ধারণা, ঠিকাদারি ব্যবসা সংক্রান্ত কোনো বিরোধের জেরে এ হত্যাকান্ড ঘটতে পারে। স্বজনদের অভিযোগ, আফজাল নামে একজন প্রভাবশালী ঠিকাদারের সঙ্গে সুলতানের বিরোধ ছিল। পাবনা কৃষক লীগের স্থানীয় নেতা আফজাল ভাড়াটে খুনি দিয়ে এ হত্যাকান্ড ঘটাতে পারেন। এ ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ নিহতের ব্যক্তিগত গাড়িচালক আমীর হোসেন ও দেহরক্ষী কামরুল হাসান শাম্মীকে আটক করেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত এ ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। এক ছেলে ও দুই মেয়ের বাবা সুলতান সবুজবাগের বাসাবো কদমতলা ব্রিজের পাশে ৮৫/২-বি নম্বরের বাসায় সপরিবারে বসবাস করতেন। স্বজনরা জানান, ২০১১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর সুলতান একবার অপহৃত হয়েছিল। দুই দিন পর ফার্মগেট এলাকায় অচেতন অবস্থায় তাকে ফেলে রাখা হয়। এরপর থেকেই তিনি দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন। নিহতের গ্রামের বাড়ি ঢাকার ধামরাইয়ে।
হত্যাকান্ডের একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, বেলা আনুমানিক পৌনে ১১টার দিকে প্রাইভেট কারযোগে মকবুল প্লাজার সামনে আসেন সুলতান। গাড়ি থেকে সুলতান ও তার দেহরক্ষী শাম্মী নামার পর গাড়িচালক প্রাইভেট কারটি কাছেই পার্কিংয়ের চেষ্টা করছিলেন। সুলতান মকবুল প্লাজার তৃতীয় তলায় তার এসএএসআই প্রাইভেট লিমিটেড নামক অফিসের দিকে এগোচ্ছিলেন। এ সময় কালভার্ট রোডের পশ্চিম দিক থেকে দ্রুত হেঁটে আসা দুই যুবক সুলতানকে লক্ষ্য করে পরপর চার রাউন্ড গুলি চালায়। লুটিয়ে পড়েন সুলতান। এরপরই অস্ত্রধারী দুই যুবক দৌড়ে ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৩০ গজ দূরে রাখা সাদা রঙের ‘এফজেড’ মোটরসাইকেলে উঠে পালিয়ে যায়। দেহরক্ষী, গাড়িচালক ও আশপাশের লোকজন সুলতানের কাছে গিয়ে দেখেন তিনি গোঙাচ্ছেন। এ অবস্থায় দ্রুত সুলতানকে তার গাড়িতে করেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। চিকিৎসকরা জানান, সুলতানের বুকে দুটি এবং পেটে এক রাউন্ড গুলিবিদ্ধ হয়।
সুলতানের মৃত্যুর খবর পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন স্ত্রী কাজী হাসিনা আফরোজ তোরা, বড় ছেলে মেহেদী হাসান সিয়ামসহ অন্য স্বজনরা। হাসপাতালের জরুরি বিভাগে স্বামীর রক্তাক্ত মৃতদেহ দেখে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন হাসিনা। জ্ঞান ফিরলেই শুরু হচ্ছিল গগনবিদারী কান্না, চিৎকার, আর্তনাদ। বাবাকে হারিয়ে ছেলেও তখন পাগলপ্রায়। স্বজনদের আহাজারিতে হাসপাতাল এলাকার পরিবেশ এ সময় ভারি হয়ে ওঠে।
কান্নারত অষ্টম শ্রেণীতে পড়ুয়া নিহতের ছেলে সিয়াম এ সময় অভিযোগ করেছে, তার বাবার সঙ্গে আফজাল নামে পাবনার একজন ঠিকাদারের বিরোধ চলছিল। পাবনার বেড়া এলাকায় পাউবোর আওতায় একটি খাল খননের ঠিকাদারি পাওয়া নিয়ে বিরোধের সূত্রপাত। ঠিকাদার আফজাল সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকুর ঘনিষ্ঠজন। গুলশানে তার অফিসও আছে।
নিহতের বন্ধু মোশাররফ হোসেন আরজু অভিযোগ করেন, পাবনা বেড়ার একটি প্রকল্পের কাজ নিয়ে স্থানীয় কৃষক লীগ নেতা দাবিদার আফজালের সঙ্গে বিরোধ অতঃপর মামলার ঘটনা ঘটে। আফজাল ওই কাজের জন্য সুলতানের কাছে ২ কোটি টাকাও দাবি করেছিলেন। কয়েকদিন আগে সেই মামলার কাজে সুলতান আদালতে গেলে সেখানেও আফজাল তাকে হুমকি দেন।
পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে নিহতের দেহরক্ষী শাম্মী বলেন, স্যার (সুলতান) গাড়ি থেকে নামলে আমিও নামি। উনি অফিসের দিকে এগোলে আমি পাশের একটি দোকানের দিকে যাচ্ছিলাম। কিছুদূর যেতেই গুলির শব্দ শুনতে পাই। দেখি স্যার রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন এবং দুই যুবক দৌড়ে পালাচ্ছে। নিহতের গাড়িচালক আমির হোসেন বলেন, স্যারকে অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং করার সময় গুলির শব্দ শুনতে পাই। পেছনে ফিরে দেখি স্যার রাস্তায় পড়ে আছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের মতিঝিল জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (এসি) সাইফুর রহমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ঠিকাদারি ব্যবসাসংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে এ হত্যাকান্ড ঘটতে পারে। প্রাথমিক পর্যায়ে সুলতানের সঙ্গে কার কার দ্বন্দ্ব-বিরোধ ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সুলতান কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। সম্প্রতি কেউ তাকে কোনো ধরনের হুমকি দিয়েছিল কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, কিলিং মিশনে দুই যুবককে ভাড়ায় ব্যবহার করা হতে পারে। হত্যাকান্ডের ধরন অনুসারে এটি পূর্বপরিকল্পিত বলেই মনে হচ্ছে। সুলতানের পকেটে নগদ লক্ষাধিক টাকা ছিল। কিন্তু সেগুলো খোয়া যায়নি। ঢামেক হাসপাতালে নেয়ার পর তার পকেটে টাকাগুলো পাওয়া গেছে।
কিলিং মিশনে দুই যুবক : ঠিকাদার সুলতান হত্যাকান্ডে দুই যুবক সরাসরি অংশ নেয় বলে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশ। যারা বেশ লম্বা এবং দুজনেরই চুল ছোট ছোট। একজনের কাছে একটি ব্যাগ ছিল। তারা সাদা রঙের একটি এফজেড মোটরসাইকেল ব্যবহার করেছে। এমনটি জানিয়েছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরাও।
সরেজমিন দেখা যায়, মকবুল প্লাজার ঠিক সামনেই ঘটনাস্থলের প্রায় ২০ গজ দূরে রাস্তায় দক্ষিণ পাশে ফুটপাতে যুবক আকিরুলের চায়ের দোকান। ঘটনার সময় তার দোকানে আকিরুলসহ কয়েকজন বসে চা-সিগারেট পান করছিলেন।
চা দোকানি আকিরুল ও পাশের আরেকটি দোকানের কর্মী শাকিল জানান, দুই যুবক এফজেড মোটরসাইকেলটি মকবুল প্লাজাসংলগ্ন পশ্চিমের মোল্লা জেনারেল স্টোর নামে দোকানের সামনে রাখে। তারা ঘটনার অন্তত ১০ থেকে ১৫ মিনিট আগে এখানে আসে। একজনের পরনে সাদা শার্ট এবং অন্যজনের কালো গেঞ্জি ছিল। আকিরুলের দোকান থেকে দুই যুবকের একজন একটি বেনসন সিগারেটও কেনে। আগের দিন বুধবারও বেলা ১১টা থেকে প্রায় দুই থেকে তিন ঘণ্টা যুবকরা এলাকায় অবস্থান করেছে। তাদের সাদা মোটরসাইকেলটি মোল্লা স্টোরের সামনে অনেকেই দেখেছেন। আকিরুল জানান, কালো গেঞ্জি পরিহিত এক যুবককে তিনি গুলি করতে দেখেছেন। দুই যুবকের আনুমানিক বয়স ২২ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে। একজনের গায়ের রঙ কালো। অন্যজন মোটামুটি ফরসা।
কাফরুলে যুবলীগ কর্মীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার : কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল কাইয়ুম জানান, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টার দিকে সেনপাড়া পর্বতা এলাকার ১৮৯ নম্বরের ভাড়া বাসার অদূরে রাস্তার পাশ থেকে মিজানুরের গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার গলার বাম পাশ থেকে কাটা। এছাড়াও শরীরের একাধিক স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। ওসি জানান, পর্বতা এলাকায় এসএ পরিবহনের অফিসের পাশে মিজানের চায়ের দোকান আছে। হত্যার কারণ জানা যায়নি। তার বাড়ি বরিশালের মুলাদীর দক্ষিণ কাজী গ্রামে। নিহতের ছোট ভাই মামুন জানান, তার ভাই ৯৪ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। এছাড়া তিনি চায়ের দোকান ও একটি সমিতি পরিচালনা করতেন। বুধবার রাতে দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে এ ঘটনা ঘটে। নিহতের কাছে কয়েক হাজার টাকা ছিল তাও খোয়া গেছে। ছিনতাইকারীরা এ ঘটনা ঘটাতে পারে। অন্যদিকে নিহতের মামা দেলোয়ারের জমিসংক্রান্ত একটি বিরোধকে কেন্দ্র করে মিজানকে প্রতিপক্ষ হুমকি দিয়েছিল। এর বাইরে অন্য কোনো কারণ দেখছেন না বলে মন্তব্য করেন মামুন।