দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে বলেছেন, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে তাঁরা কোনো নির্বাচনে অংশ নেবেন না। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে নির্বাচন প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য সরকারি দলের ঘোষণাকে আগাম নির্বাচন করার আভাস বলেও মনে করেন বিএনপির অনেক নেতা। তাঁদের সন্দেহ, আগামী বছর ২০২২ সালেই সরকার আরেকটি নির্বাচন করে ফেলতে পারে। কারণ ২০২৩ সালে সরকারকে বড় ধরনের আন্দোলনের মুখে পড়তে হতে পারে; পাশাপাশি নির্বাচনের আগে সরকারবিরোধী মেরুকরণের সম্ভাবনা রয়েছে বলে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা আছে। তাই সম্ভাব্য বৃহত্তর ঐক্যকে ভণ্ডুল করা এবং অন্য দলগুলোকে নির্বাচনমুখী করে আন্দোলন থেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবেই সরকার নির্বাচন প্রস্তুতির বিষয়টি মাঠে ছেড়েছে বলে মনে করে বিএনপি।
দলটি বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে প্রায় এক বছর ধরে স্থানীয় সরকার ও সব উপনির্বাচন বর্জন করে আসছে। তা ছাড়া আগামী নির্বাচনে অংশ না নিলেও বিএনপির নিবন্ধন বাতিল হওয়ার কোনো সম্ভবানা নেই। নির্বাচন কমিশনের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুযায়ী পর পর দুই মেয়াদ নির্বাচনে অংশ না নিলে একটি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গত ২০১৮ সালের নির্বাচনে ওই ঝুঁকি থাকলেও এবার বিএনপির তা নেই। বিষয়টি দলটির নীতিনির্ধারকদের ভাবনায় আছে বলে জানা গেছে।
সরকারের মেয়াদ পূর্ণ হলে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। সে হিসেবে নির্বাচনের বাকি রয়েছে আরো দুই বছর তিন মাস। কিন্তু গত ৯ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় হঠাৎ করেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়ার দিকনির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর এই ঘোষণায় বিএনপি কিছুটা হোঁচট খেলেও নির্বাচন নিয়ে এখনই ঝাঁপিয়ে
পড়তে রাজি নয়। সরকারের ওই ঘোষণার পর দলটির নেতারা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলেও নির্বাচনের জন্য তেমন কোনো প্রস্তুতি বা আলোচনা শুরু করেননি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই বছরের বেশি সময় আগে নির্বাচনের প্রস্তুতির কথা বলা বেশ সন্দেহজনক। মনে হচ্ছে, বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করে ফেলতে চাইছে। কিন্তু আমরা তাদের ওই ঘোষণাকে গুরুত্ব দিতে চাই না।’ তিনি বলেন, ‘গত প্রায় এক বছর ধরে আমরা এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাচ্ছি না। আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই সরকারের পতন ঘটিয়ে একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মনে করেন, ‘বিরোধী দলকে অপ্রস্তুত রেখে আওয়ামী লীগ সরকার যেনতেন প্রকারের আরেকটি নির্বাচন করে ফেলতে চায়। কিন্তু দেশের মানুষ এত বোকা নয় যে, তারা আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন করলেই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে।’ তিনি বলেন, ‘নিরপেক্ষ সরকার ও নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়া এ দেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’
‘আমরা সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান সরকারের অধীনে সমস্ত স্থানীয় সরকার নির্বাচন ও উপনির্বাচন বর্জন করে আসছি। ফলে তাদের অধীনে নির্বাচনে যাওয়া অর্থহীন’ বলেন মির্জা ফখরুল।
দলের স্থায়ী কমিটির অত্যন্ত সক্রিয় সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপিকে নির্বাচনের ফাঁদে ফেলতে চায়। উদ্দেশ্য হলো, তাদের সীমাহীন দুর্নীতি ও ব্যর্থতা ঢেকে ফেলে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে ফেলা। নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের ব্যস্ত রাখা।’ ‘কিন্তু স্পষ্টভাবে বলতে চাই, শেখ হাসিনার অধীনে আরেকটি প্রহসনের নির্বাচন এ দেশে হবে না’ বলেন টুকু।
দলের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান মোহম্মদ শাহজাহান মনে করেন, ‘বিএনপিকে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে টোপ দিয়ে সরকার নির্বাচনে নিতে চায়। কিন্তু তাদের কোনো ফাঁদে আমরা আর পা দিচ্ছি না।’ তিনি বলেন, ‘সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে চাইলে আগাম নির্বাচন তারা করে ফেলতে পারে। কিন্তু বিএনপি কিংবা জনগণের ওই নির্বাচন নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপি এখনো কোন কোন ইস্যুতে বৃহত্তর ঐক্য গঠন করা হবে তার রূপরেখা প্রণয়ন নিয়েই ব্যস্ত আছে। সম্প্রতি স্থায়ী কমিটির বিশেষ বৈঠক ডেকে ওই রূপরেখা ও দাবিনামার খসড়া তৈরি করা হয়। এরপর শনিবারের বৈঠকে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সভা ডেকে এ বিষয়ে মতামত গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে মঙ্গলবার থেকে শুরু হওয়া ওই সভায় সরকারবিরোধী আন্দোলন, বৃহত্তর ঐক্য ছাড়াও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে নেতারা মতামত দেবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।