গত ১৫ বছর আগে ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে হাজীগঞ্জের এক ব্যবসায়ীর সন্তান ও কলেজের অধ্যাপকের সন্তান(নাম গোপন রাখা হলো)। তখন শিক্ষিত ও ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে একটি কৌতহল সৃষ্টি হয়। যদিও সাধারণ মানুষ বুঝতো না ফেনসিডিল কি? তার পরেও বুঝতো এটা একটি নেশা। তখন ঐ শিক্ষক ও ব্যবসায়ীর ছেলেকে থানা থেকে ছেড়ে নেয়ার চেষ্ঠা করেও ব্যর্থ হয়। তখনকার সাংবাদিকদেরকে বলা হয়েছে পত্রিকায় যেন সংবাদ প্রকাশ করা না হয়। কিন্তু সাংবাদিকরা ঠিকই দায়িত্বের কারণে এ সংবাদ চাঁদপুরের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকায় পাঠালো। পত্রিকার কর্তৃপক্ষ ফলাও করে ছবিসহ ছেপে দেয়। এ নিয়ে রীতি মতো একটি হইচই শুরু হয়। ঐ ব্যবসায়ী ও শিক্ষকের দু সন্তানকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসে বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয় নিজের ইজ্জত রক্ষা করার জন্য। তখন থেকেই শুরু হয় ফেনসিডিল নিয়ে আলোচনা। এর পর থেকে আবিস্কার হতে থাকে হাজীগঞ্জ উপজেলা মধ্যে কোন কোন শ্রেনীর লোক বা লোকেরা এ নেশায় লিপ্ত। আস্তে আস্তে বের হতে থাকলো সবার আসল খবর। তখনকার সময় সাংবাদিকরা অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখে এ ফেনসিডিল ব্যবসা করে থাকেন রাজনীতিক নেতা, ব্যবসায়ীরা। আর এ ফেনসিডিল বহন করেন তখনকার সময় রিক্সা চালক বা অভাবী ঘরে সন্তানরা। তারা কুমিল্লা থেকে ফেনসিডল নিয়ে হাজীগঞ্জে নিয়ে আসলে তাদেরকে কিছু টাকা দেয়া হতো। এভাব্ েহাজীগঞ্জের মধ্যে ফেনসিডিল অবাধ বেচা কেনা চলতো। এর পরপরই পুলিশের অভিযানে অনেক রাঘব বোয়াল পরিবারে সন্তান ফেনসিডিলসহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। এ নিয়ে রীতিমতো শিক্ষিত সমাজের মধ্যে আতংঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ফেনসিডিল সেবক ও ব্যবসায়ীরা থেমে থাকেনি। তারা ঠিকেই চালিয়ে যাচ্ছে ফেনসিডিল ব্যবসা। কারণ একটা ফেনসিডল ক্রয় করতো ২শত টাকা আর বিক্রি করতো ৬/৭শত টাকা। এতো লাভের ব্যবসা কিভাবে ছাড়ে। অল্প দিনে ধনী হওয়ার জন্য যুক্ত হয় আরো অনেকে। এভাবে ছড়িয়ে পড়ে ফেনসিডিল। যথনই পুলিশের অভিযান বেশি লক্ষ করা গেছে তখনই মাদক ব্যবসায়ীরা কৌশলে কিছু দিন নীরব থাকে। তখন এক মাদক ব্যবসায়ীর সাথে কথা হলে তিনি বলেন ফেনসিডিল আকারে বড় হওয়ার কারণে আমরা ধরা পড়ে যাই তাড়া তাড়ি। ২০/৩০ টা ফেনসিডিল আনতে বস্তা বা কার্টুন লাগে আবার রাখতে অনেক জায়গা লাগে। আবার পুলিশের ভয় কাজ করে সব সময়। কোন ধরণে লোকেরা ফেনসিডিল খায় জানতে চাইলে তিনি বলেন শিক্ষিত পরিবার, ব্যবসায়ী পরিবার ও এক শ্রেনীর রাজনীতিক কর্মীরা খেয়ে থাকেন। এ ভাবে বিস্তার শুরু হয় ফেনসিডিলের ।
গত ৮/১০ বছর যাবত ফেনসিডিলের সেবনের পরিবর্তে শুরু হয় ইয়াবা। এটা দেখতে টেবলেটের মতো। যা ৫ শত বা এক হাজার পিস পকেটে রাখলেও দেখা যায় না এবং বুঝা যায়না। ইয়াবা কি তা অবশ্য সংবাদ কর্মীরা বুঝতো না। ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করে ইয়াবা ফেনসিডিলের চেয়ে ভয়াবহ মরণ নেশা। এ নেশা খেলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে যায় এবং অস্তির অস্তির ভাব কাজ করে এবং মৃত্যুর ঝুকি বেড়ে যায়। আর এর বিস্তার এখন সর্ব ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়েছে। এ মরণ নেশা ইয়াবার আগুন এখন প্রতিটি ঘরে ঘরে ঢুকে গেছে। এ নিয়ে অশান্তিতে ভুগছে শত শত পরিবার। শুধু এই দুই যুবকের ঘটনা নয়, আছে অসংখ্য উদাহরণ। উপজেলার শত শত পরিবারে চলছে মাদকের দহন। ছাত্রছাত্রী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী, শিক্ষক, চিকিৎসক, শ্রমজীবীসহ সব শ্রেণির মানুষই মাদকের নীল বিষে আক্রান্ত। ভেঙে যাচ্ছে সর্ম্পকের বন্ধন। মাদকের ছোবল শুধু কারো একটি জীবন বিষাক্ত করছে না, গ্রাস করছে একেকটি পরিবার। একটি সন্তান, একটি মানুষ মাদকাসক্ত হলে বিপন্ন হয়ে পড়ছে পুরো পরিবার। মাদকের নেশায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে সন্তান। সুশৃঙ্খল, সুন্দর জীবনকে পেছনে ফেলে ক্রমেই হারিয়ে যায় অন্ধকারে। নেশার টাকার জন্য পরিবারে সৃষ্টি করে চরম অশান্তি। অনেক সময় মাদকাসক্ত সঙ্গীদের প্ররোচণায় অপরাধ জগতেও পা বাড়ায়। হারিয়ে যায় মা-বাবার চোখের ঘুম। অবস্থা এমন হয় যে একেকটি পরিবারে তৈরি হয় বিচ্ছেদের দেয়াল। মা-বাবার আদরের সন্তান হয়ে যায় সবার চোখের বালি। স্বজনরাও নিরাপদ থাকে না মাদকাসক্তদের কাছে। আদরের কোমল মুখে ভেসে ওঠে খুনির মূর্তি। ভাইকে খুন করতে হাত কাঁপে না ভাইয়ের। বোনও নিরাপদ নয় মাদকাসক্ত ভাইয়ের কাছে। স্বামীর হাত লাঞ্জিত হয় স্ত্রী । এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মা-বাবারও মৃত্যুদূত হয়ে ওঠে তাদেরই নারীছেঁড়া ধন। কারণ, সে মাদকাসক্ত।
আমার কণ্ঠের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এমন সব সত্য, যা ভাবতে গিয়ে আঁতকে উঠতে হয়, শিউরে উঠতে হয় এ জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। এ এক নীরব ঘাতকের মতো ভেতরে ভেতরে শেষ করে দিচ্ছে বলা যায় একটি জাতির সব কিছুকে। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ ভর করে আছে যে যুবশক্তির ওপর, তার বড় একটি উজ্জ্বল অংশই আজ ‘মরে’ আছে মাদকের বিষে। সমাজের আশীর্বাদের বদলে তারা এখন যেন সমাজের অভিশাপ। সব দেখেশুনে বলতে হয়, এ জাতির সামনে আজ সবচেয়ে বড় অভিশাপের নাম মাদক।
মনোচিকিৎসক, সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সর্বনাশা ইয়াবা, হেরোইন, ফেনসিডিল, প্যাথেড্রিন, সিসা, মদ, বিয়ার, কোকেন, গাঁজাসহ অনেক কিছু এখন পৌঁছে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় তরুণ-তরুণীদের হাতে। সঙ্গদোষেই মাদকাসক্তির ঘটনা ঘটছে বেশি। তবে পরিবারে অশান্তি, সামাজিক অনুসাশন মেনে না চলা, অভিভাবকের অবহেলা, আশপাশের পরিবেশ ও মাদকের সজলভ্যতার কারণে মানুষ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে। এ ছাড়া আইনি নজরদারিতেও বড় রকমের দুর্বলতার কথা বলেন অনেকে।
সাধারণত পাঁচটি মাদকদ্রব্য সবচেয়ে বেশি প্রচলিত; যার বেশির ভাগই ব্যবহার করে থাকে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা। এগুলো হলো ইয়াবা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেড্রিন ও সিসা। ২০০৮ সালের এক পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে আনুমানিক মাদকসেবীর সংখ্যা ছিল ৫০ লাখ যার ৯১ শতাংশই তরুণ। আর ওই সময় মাদকের পেছনে দেশে ব্যয় ছিল এক হাজার সাত কোটি টাকা। এ হিসাবে গত ৬ বছরে মাদকসেবী ও ব্যয়ের হার কয়েক গুণ বেড়ে গেছে বলে ধারণা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দায় সমাজের গভীরে : জানতে চাইলে অধ্যাপক ইবনে হাছান জাহেদ আমার কণ্ঠকে বলেন, আমাদের দেশে এখন বিভ্রান্তিকর সামাজিক পরিস্থিতি বিদ্যমান। তরুণ প্রজন্ম দুইধারার মধ্যে পড়ে দিশাহারা অবস্থায় আছে। একদিকে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতি, ধর্মীয় অনুশাসন আরেক দিকে ইন্টারনেট বা অন্যান্য আকাশ সংস্কৃতির আওতায় উচ্চমাত্রায় উন্মুক্ত উন্মাদনা। একটার সঙ্গে আরেকটা একেবারেই বিপরীত। এমন টানাপড়েনের কবলে দিশেহারা প্রজন্ম ঝুঁকে পড়ছে সুখবাদের দিকে। পারিবারিক মূল্যবোধ, আদর্শ, শিক্ষা-দীক্ষা সব কিছুই তুচ্ছ হয়ে উঠছে। আবার আগের মতো উপযুক্ত পারিবারিক বন্ধন, মায়া-মমতা-ভালোবাসাও টুটে যাচ্ছে সহজেই। অভিভাবকরা নিজেরাও অতিমাত্রায় ভোগবাদী ও প্রতিযোগী হয়ে উঠছেন। ফলে মা-বাবাদের কাছে এখন সন্তানদের জন্য প্রয়োজনীয় সময় দেওয়া, দেখভাল করার গুরুত্ব কমে গেছে। এর ফাঁক গলেই সর্বনাশা মাদক ঢুকে পড়ছে নতুন প্রজন্মের অস্তিত্বে।
মাদকাসক্তির কারণে অনেকেই ঐশীর মতো হিংস্র হয়ে উঠছে। যেসব পরিবারে হত্যাকাণ্ড ঘটেনি তারাও আছে চরম আতঙ্ক-উৎকণ্ঠায়। মাদকাসক্ত সন্তান তছনছ করছে ঘরের জিনিসপত্র। মারধর করছে স্বজনদের। অতিষ্ঠ হয়ে মা-বাবা নিজেই ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দিচ্ছেন। আঞ্জুমান আরা নামে এমনই এক মায়ের সঙ্গে কথা হয় সম্প্রতি। রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরের হুজুরপাড়ার বাসিন্দা এই মা কেঁদে বলেন, ‘সন্তানকে ফেরাতে অনেক চেষ্টা করেছি। কাজ হয়নি। আগেও একবার জেলে দিছি। ফিরা আইসা যেই সেই। আশা করছিলাম, বিয়া দিলে ঠিক হইব। বিয়া দিয়া আরেকটা মাইয়ার জীবন ধ্বংস করছি।’ এই মায়ের মাদকাসক্ত ছেলে টুলু ছয় মাস ধরে মাদকের মামলায় জেলহাজতে আছে।