সত্যব্রত ভদ্র মিঠুন :
আবার আমাদের সন্নিকটে খুব কাছাকাছি পহেলা বৈশাখ। বাঙালী জাতির সব কিছুর উর্ধ্বে থেকে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালবাসা, একই মানের প্রতিফলন ঘটানোর দিন। বৈশাখের প্রথম সকালে মসজিদ থেকে ধ্বনিত্ত হবে মোয়াজ্জেমের পবিত্র আযান। মুসল্লীগণ পুরানো বছরের ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠবে অযু সেরে মহান আল্লাহর ঘর মসজিদে নামাজ আদায় করবেন। নতুন বছরের শুভ কামনায় উন্নত শান্তি শৃঙ্খলা যুক্ত জীবন কামনায় রাব্বুল আলামিন আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইবেন। ছোট ছোট সোনা মনিরা মক্তবে ছুটে যাবে দ্বীন শিক্ষা লাভের আশায়। মন্দিরে শঙ্খ, কাসা, ঘন্টা, উলুধ্বনির শব্দে বক্তবৃন্দ নতুন দিনের নতুন বছরের প্রথম প্রহরে দেবতার সান্নিধ্য লাভে ছুটে চলবেন। কেউ বা পুত্র-নাতি-নাতিন কে বা স্ত্রী সন্তানকে সাথে করে বছরে শুরু করবেন মন্দিরে প্রণাম ও পূজো দিয়ে। এতো হলো মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় পবিত্র চিন্তা। বাঙালীদের সকলের সামাজিকভাবে মিলনের সুন্দর দিন, শ্রেষ্ঠ সময় পহেলা বৈশাখ। এ দিন বাঙালী সমাজ তাদের সংস্কৃতি, কৃষ্টি, সভ্যতার মিলন ঘটিয়ে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলে এক হয়ে একই রীতিতে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয়। এখন বাঙালীর প্রতি ঘরে ঘরে ছেলে-মেয়েদের বৈশাখী পোষাক কেনার বায়না। শহরে গ্রামে কাছাকাছি স্থানে মেলায় গিয়ে দোকানীদের কাছ থেকে খেলনা পুতুল বাশি, ঘর গোছানোর তৈজস পত্র, জামাকাপড়, চুড়ি, ধুল, নেইলপলিস, বাঁশ-কাঁঠ বেতের তৈরী বিভিন্ন জিনিস, লোহা লস্কর, মিস্টি জিলাপী, মন্ডা কেনার প্রস্তুতি চলছে। বৈশাখী পোষাক তৈরির কারিগরদের বিভিন্ন খেলনা তৈরি করা, কামার কুমারদের মাছ, মিস্টি বিক্রেতা। এ দিনে বিশেষ বিক্রির আশায় সওদাগররা তাদের চুরি, ধুল, বিভিন্ন অঙ্গ সাজ নিয়ে মেলায় বসার জন্য প্রস্তুত। বাঙালী ছেলেরা মেয়েরা তাদের পুরানো বছর জুড়ে জমানো অর্থ নতুন বছরে বয়োজ্যোষ্ঠদের পাওয়া টাকা দিয়ে লাল নীল সবুজ, হলুদ, গোলাপী কত না রঙ্রে বাহারী জিনিস দিয়ে নিজেকে সাজাবেন। সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ, র্যালী, গান, কবিতা আবৃত্তি যেমন খুশী তেমন সাজ, আলোচনা সভা, বৈশাখী মেলা ইত্যাদির আয়োজন করে বাংলা নববর্ষকে বরণ করবেন। এতে সকল ধর্ম শ্রেণী পেশার মানুষের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা পুস্পটিত হবে। নব বর্ষের সকল স্থানে আমাদের সংস্কৃতি মনের মধ্যে পুঞ্জিবিত আকাঙ্খা আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দৃষ্ট্যমান হয়। সকলের ইচ্ছা থাকে পুরান বছরের সকল ভুল শুদ্ধে নতুন করে নিজেকে তৈরি করে অভাব, অভিযোগ ও জ্ঞানী শেষ করে ভাগ্যের চাবি কাঠি বদল করে নিজেদের জীবন হয়ে উঠুক সুন্দর, শান্তি, শৃঙ্খলা ও ঝামেলা মুক্ত। বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে ব্যবসায়ীরা তাদের দোকানপাঠ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ধোয়া মোছার কাজ শেষ করে বর্ণাঢ্য হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন। এ অনুষ্ঠানে পাইকাররা আমন্ত্রিত হয়ে পুরানো বছরের দেনা-পাওনা শোধ করে নতুন বছরের কাজ শুরু করবে। এটাও বাঙালীর সামাজিক রীতি। কোথাও মিলাদ শরীফ, দোয়া মাহফিল, কোথাও পুজা অনুষ্ঠান শেষে দেনাদার ও পাইকার- মহাজনদের মধ্যে মিষ্টি সন্দেশ জিলাপী ঠান্ডা পানীয় খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। এদেশে বাঙালী পরিবারগুলো বছরের শেষ ভাগে ঘর দুয়ার পরিস্কার, সংস্কার করে। নতুন বছরের প্রথম শুভ নববর্ষের দিনে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী ভালো খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। একে অন্যের বাড়ীতে আমন্ত্রিক অতিথি হিসেবে আপ্যায়িত হন। খুশীর বর্ন্যা বয়ে যায়, পুরো বাঙালী সমাজে, নববর্ষের দিনে প্রতি ঘরে ঘরে মিস্টি দিয়ে আপ্যায়িত করে। এ দিন কোনো ধর্মান্ধত্তা, মৌলবাদ, বাঙালী সমাজকে কুলষিত করতে পারে না। গানে, নাটকে, কবিতার ছন্দে, নাগর দোলায়, পুতুল নাচে, কৃষিজীবি বাঙালী সমাজে নবান্ন উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামে গ্রামে কৃষকের ফসল ফলানোর হাসি ফল গাছে আম, জাম, কাঁঠানোর ছড়াছড়ি, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। শুভ নববর্ষে নতুন করে সাজবে। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথের এসো হে বৈশাখ, এসো এসো গান মনের মধ্যে ধ্বন্নিত হচ্ছে। আব্দুল আলিমের শুনোগো রুপসী কন্যাগা কার লাগিয়া গাথো ফুলের মালা গানের সাথে ছোট বেলায় বন্ধুরা মিলে কাঠ বাজিয়ে সুর তুলে বর্ষ বরণ সিঙ্গারা, মিস্টির প্যাকেট শেয়ার করার আনন্দ আজও স্মৃতি অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশকে বার বার গভীর শ্রদ্ধায় মনে পড়ছে। শিল্পীর গানের ভাষায় নেই, বেদাবেদ হেতা, কুলী আর মজুরী নেই ভেদাভেদ হেতা, চাষী আর কামারে, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান এক মাতাদের সকলের এটাই আমাদের প্রহলে বৈশাখ। এখানে সকলে আমার মা, সকলের আমার বাবা, সকলের আমার ভাই, সকলের আর বোন, সকলের আমার অভিভাবক, সকলে আমার বন্ধু, সকলের আমার আপনজন। এ দেশ বিশ্ব কবির সোনার বাংলার, নজরুলের বাংলাদেশ। জীবাবন্দ রুপসী বাংলা, রুপ যে তার নেইকো শেষ বাংলাদেশ। এ দেশে জন্মেছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিব, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সওরাওয়াদী, মাওলানা ভাসানী, মাস্টার দ্যা সূর্য্য সেন, খুদিরাম, ভাষা শহীদ সালাম, জব্বর, রফিক, সফিক, বীর শ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, সিপাহী হামিদুর রহমান, সিপাহী মোস্তফা কামাল, মো: রুহুল আমিন, ফ্লাইট ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান, লেন্স নায়েক মুন্সী আবদুর রউফ, লেন্স নায়েক নুর মোহাম্মদ শেখ, জাতীয় ৪ নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজ উদ্দিন আহমেদ, এম কামরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন মুনছুর আলী সহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা, স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে শহীদ লাখো মুক্তি পাগল, বাংলা মায়ের গর্বিত সন্তান, তাদের চেতনার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে ১৪২২ বাংলা সনের প্রথম প্রহর হতে বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জে, মাঠে, ঘাটে, হাঁটে বাজারে মেলায় সভা সমিতিতে, সাংস্কৃতিক অজ্ঞনে, রাষ্ট্রীয়ভাবে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় মহান মুক্তিযোদ্ধের চেতনায় আমাদের সকলের ভালবাসার অন্তরের, হৃদয়ের আগামীর চেতনায় বাংলাদেশ গড়বো। হিংস্রা বিরোধ, মৌলবাদ, ধর্মাদ্ধতাকে বিতাড়িত করে সকলের জন্য সুন্দর পরিবেশে নব চেতনার নতুন সূর্য্যরে হাসি মাখা মধু ময় দিন। এ হউক নতুন বছরের প্রত্যাশা।