ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যাকান্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে যাদের নাম এসেছে, তাদেরই একজন ফেনী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজামউদ্দিন হাজারীকে বাঁচাতে তৎপর একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী। এ কারণে মামলার মোটিভ ঘুরছে ভিন্ন পথে। এ অবস্থায় মামলার ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় একরাম সমর্থক এবং স্বজনরা। হত্যাকান্ড ঘটনার কিলাররা সবাই নিজাম হাজারীর অনুসারী ও ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত। এদিকে বিএনপি নেতা মাহতাব চৌধুরী মিনারকে সাত দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। তিনি একরাম হত্যার এহাজারভুক্ত আসামি।
সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানায়, ফেনী শহরের জনাকীর্ণ সড়কে প্রকাশ্যে এ ধরনের পৈশাচিক হত্যাকান্ডের ঘটনার খবর আগে থেকে প্রশাসন জানলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রত্যক্ষদর্শীরাও ঘটনার আগে-পরে ঘটনাস্থল কিংবা তার আশপাশে গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষ কর্মকর্তাকে দেখেছেন। ঘটনার সময় একরামের ব্যক্তিগত গাড়িচালক মামুন ওই সড়কে দায়িত্বরত পুলিশ টহল টিমের হাতে-পায়ে ধরেও কোনো সহায়তা পাননি। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে আওয়ামী লীগের এক হেভিওয়েট নেতা সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর উপস্থিতিতে একরামের ভাই রেজাউল হক জসিমের কাছ থেকে সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেন। পরে তড়িঘড়ি করে ওই কাগজে উপজেলা নির্বাচনে একরামের প্রতিদ্বন্দ্বী মাহতাব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী মিনারের নাম উল্লেখ করে ৩৫-৪০ জনকে অজ্ঞাত আসামি দেখিয়ে এজাহার করা হয়। ঘটনার দিন বিকালে সার্কিট হাউসে প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে ফেনী আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে হত্যাকান্ডের ঘটনাকে ভিন্ন পথে নেয়ার নানা কৌশল নেয়া হয়। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহল থেকে হত্যাকান্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাতে নির্দেশ দেয়া হলে পরদিনই ঢাকায় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য নিজাম হাজারীর মামাতো ভাই ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লায়লা জেসমিন বড় মনির ছেলে আবিদসহ আটজনকে গ্রেফতার করে র্যাব। এদের গ্রেফতারের পরই বেরিয়ে আসে হত্যাকান্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য। আবিদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী ফুলগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক জাহিদ চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৬৪ ধারায় জাহিদ চৌধুরী জবানবন্দিতে আদালতকে জানান, হত্যাকান্ডের আগের দিন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও ফেনী আওয়ামী রাজনীতির কুপরামর্শদাতা জাহাঙ্গীর আদেলের বাসায় হত্যা পরিকল্পনার ছক অাঁকা হয়। এরপর জাহিদ চৌধুরীর আস্তানা মিজান রোডের সালাম কমিউনিটি সেন্টারে সেই ছক অনুযায়ী কাউন্সিলর শিবলুসহ ৫-৬ জন করে কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়। তাদের হাতে তুলে দেয়া হয় ৫টি অস্ত্র, বোমা ও ককটেল। মোটরসাইকেলে ঘুরে পুরো ঘটনার তদারকি করেন জাহাঙ্গীর আদেল। সঙ্গে নিজাম হাজারীর অস্ত্রভান্ডারের নিয়ন্ত্রক পৌর যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক জিয়াউল আলম মিস্টার ও আরেক যুবলীগ নেতা সাহেদ মামুন ছিলেন। ঘটনার ভিডিওচিত্র দেখে কিলাররা একের পর এক গ্রেফতার হতে থাকলে আলোচনায় আসে আদেল, মিস্টার ও নিজাম হাজারীর সংশ্লিষ্টতা। ঘটনার আগে ও পরে মোবাইল ফোনের কললিস্টের সূত্র ধরে তাদের সংশ্লিষ্টতা পান তদন্ত কর্মকর্তারা। নিজাম হাজারী এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, ঘটনার দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রটোকল অফিসার আলাউদ্দিন আহমদ চৌধুরী নাসিমের বাসায় ছিলেন। নাসিমের নেতৃত্বে ফেনী আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ বলেও তিনি জানান। তবে আলাউদ্দিন নাসিম আওয়ামী লীগের কোন পদে রয়েছেন কিংবা কেন তার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তর তিনি এড়িয়ে যান। তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, আলোচিত এ হত্যাকান্ডে নাসিম ও নিজামের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। নিজেকে বাঁচাতে আদেল ও মিস্টারকে পুলিশের যোগসাজশে আত্মগোপনে যেতে নিজাম হাজারী সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
নিজাম হাজারী এমপিকে বাঁচাতে নানা কূটকৌশল অবলম্বন করছে প্রশাসন। গ্রেফতারের পর পুলিশ সুপার তড়িঘড়ি সংবাদ সম্মেলন করে ঢাকায় গ্রেফতার মিনার চৌধুরীকে ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে উল্লেখ করলেও গ্রেফতারকৃতদের কেউই তার সংশ্লিষ্টতার কথা বলেনি। তবে হত্যাকান্ডের পর থেকেই নিজাম হাজারী কিংবা ফেনী আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিগত উপজেলা নির্বাচনে দ্বন্দ্বের কথা উল্লেখ করে বর্বর এই হত্যাকান্ডের জন্য মিনার চৌধুরীকেই দায়ী করা হচ্ছে। যদিও গ্রেফতার হওয়া সবাই নিজাম হাজারীর ঘনিষ্ঠজন।
রিমান্ডের আসামিদের সঙ্গে নিজাম হাজারীর সাক্ষাৎ : একরাম হত্যাকান্ডের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত আসামিদের কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে পুলিশ লাইনে রিমান্ড চলছে। রিমান্ড চলাকালীন কোনো নিকটাত্মীয়ের দেখা করার সুযোগ না থাকলেও তাদের সঙ্গে গভীর রাতে সংসদ সদস্য নিজাম হাজারী দেখা করেছেন বলে ব্যাপক গুঞ্জন রয়েছে। সাক্ষাৎকালে তিনি আবিদ, জাহিদ ও শিবলুসহ গ্রেফতারকৃতদের ছাড়িয়ে নেয়ার অভয় দিয়েছেন। তবে দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হয়নি।
খুনিদের নিয়ে জানাজা ও কুলখানিতে অংশগ্রহণ : হত্যাকান্ডে জড়িতরাও অংশ নিয়েছে একরামের কুলখানি ও মানববন্ধনে। উপজেলা কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দোয়া মাহফিল শেষে মানববন্ধনে যোগ দেন ফেনী সদর আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী এবং সভাপতি আবদুর রহমান বিকম। তাদের দেখেই দলীয় নেতাকর্মীরা হই-হট্টগোল শুরু করলে নিজাম হাজারী বক্তব্য সংক্ষেপ করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে জেলা সভাপতি আবদুর রহমান বিকম বক্তৃতা না দিয়ে ফেনী ফিরে যান। দলীয় নেতাকর্মীদের অভিযোগ, একরাম হত্যায় জড়িতদের অনেককে নিজাম হাজারীর গাড়ি বহরে দেখা গেছে। এদের মধ্যে শহরের বিরিঞ্চি এলাকার পৌর কাউন্সিলর শিবলু ও যুবলীগের শীর্ষ ক্যাডার মিস্টারও ছিল। হত্যাকান্ডের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এদের নাম ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। তারা জানান, বিপুলসংখ্যক পুলিশ ছাড়াও নিজাম হাজারী শহর থেকে দলের সশস্ত্র ক্যাডারদের পাহারায় মানববন্ধনে অংশ নেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু জানান, তাদের উপস্থিতি দেখে খোদ তার ভাই-বোনেরাই ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, হত্যাকান্ডে জড়িতরা কুলখানিতে এলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে পরিবারের লোকজন মুখ বুজে এসব হজম করেছেন।
মামলা সিআইডিতে নেয়ার দাবি : একরাম হত্যাকান্ডের ঘটনায় খুনিদের চিহ্নিত করতে সুষ্ঠু তদন্তে ফেনী পুলিশের ওপর আস্থা রাখতে পারছেন না উপজেলা চেয়ারম্যানরা। এক সংবাদ সম্মেলনে উপজেলা চেয়ারম্যান সমিতির আহ্বায়ক ও মানিকগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা বলেন, নৃশংস এ হত্যাকান্ডে জড়িত কিলারদের সঙ্গে প্রশাসনের ভালো যোগাযোগ রয়েছে। ঘটনায় গ্রেফতারকৃতরা ফেনী থানায় থাকলে একরাম হত্যার প্রধান ইন্ধনদাতা গ্রেফতার হবে না। মামলার অগ্রগতিও হবে না। মামলার অগ্রগতি ও প্রধান কিলারদের শনাক্ত করতে গ্রেফতারকৃতদের ফেনী থেকে ঢাকায় হস্তান্তর করতে হবে। সেই সঙ্গে মামলাটি সিআইডি অথবা ডিজিএফআই’র কাছে হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি।
আরও একজন আটক : হত্যাকান্ডের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বুধবার দুপুর ১২টা ৫০ মিনিটের দিকে জিয়াউর রহমান বাপ্পি (৩০) নামের আরও একজনকে ফেনী-মাইজদী সড়কের সিলোনীয়া বাজার সংলগ্ন এএইচএম রহমান ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে গ্রেফতার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। সে বিরিঞ্চি এলাকার মোঃ হানিফের ছেলে। তবে ঘটনার পর থেকে বাপ্পি পলাতক ছিল। এ বাপ্পিও নিজাম হাজারীর ক্যাডার বাহিনীর সক্রিয় সদস্য।
নিজাম হাজারীর গ্রেফতার দাবি : ফুলগাজীতে বুধবার সকালে মানববন্ধন করেছেন আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। এসময় তারা ফেনী সদরের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিজাম উদ্দিন হাজারী হত্যাকান্ডে জড়িত বলে তার গ্রেফতার দাবি করেন। বিক্ষুব্ধরা সড়ক অবরোধ করে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে ফাঁসির দাবিসহ নানা সস্নোগান দেন। তারা বলেন, যারা নিজাম হাজারীর বাসায় সারাক্ষণ ঘুরঘুর করে, তারাই করছে মামলার তদন্ত।
বিএনপি নেতা মিনার চৌধুরীর সাত দিনের রিমান্ড : ফেনীর ফুলগাজী উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ সভাপতি একরামুল হক একরাম হত্যাকান্ডের ঘটনায় এজাহারভুক্ত আসামি বিগত উপজেলা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি সমর্থিত প্রার্থী মাহতাব উদ্দিন আহমদ চৌধুরী মিনারকে সাত দিনের রিমান্ডে দিয়েছেন আদালত। বুধবার বিকালে সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক খায়রুল আমিন এ আদেশ দেন। বিকাল ৪টার দিকে মিনার চৌধুরীকে আদালতে এনে ১০ দিনের রিমান্ড দাবি করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ফেনী মডেল থানার ওসি (তদন্ত) আবুল কালাম আজাদ। আদালত শুনানি শেষে সাত দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন। অন্যদিকে রিমান্ড আবেদন বাতিল করে মিনার চৌধুরীর পক্ষে একাধিক আইনজীবী তার জামিন আবেদন করেন। আইনজীবীরা জানান, নির্মম এ হত্যাকান্ডে জড়িত ও পরিকল্পনাকারীদের নাম এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। এই হত্যাকান্ডে মিনার চৌধুরীর সম্পৃক্ততা নেই দাবি করে আইনজীবীরা বলেন, তাকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত মামলায় আসামি করা হয়েছে। আদালত প্রাঙ্গণে মিনার চৌধুরীর স্ত্রী মাহবুবা হাসনাত চৌধুরী নাহরিন সাংবাদিকদের জানান, জঘন্যতম এ হত্যাকান্ড কারা ঘটিয়েছে তা দেশবাসীর কাছে পরিষ্কার। আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম হাজারীকে আড়াল করতেই মিনার চৌধুরীর ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা চলছে। তিনি এর নিন্দা জানিয়ে অবিলম্বে মিনার চৌধুরীর মুক্তি দাবি করেন। এসময় তার মেয়ে নিতল ও প্রিয়াঙ্কা উপস্থিত ছিলেন। অপরদিকে জাহিদ চৌধুরীর অস্ত্রসহ বিরিঞ্চি থেকে গ্রেফতারকৃত সজিবকে দুই দিন ও সদর উপজেলার কাজিরবাগ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুর রবকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দিয়েছেন আদালত।