মানিক দাস
চাঁদপুর শহরে সমাহিত ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে আত্মদানকারী দু’কিশোরের কবরটি আজ অযতেœ-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। কবরটি থেকে পাথরে লেখা নামফলকটি নেই বললেও চলে। আর এ কবরটি কালের স্বাক্ষী হয়ে রয়েছে মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী বাড়ি’র সামনে।
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের সময়কার চাঁদপুর মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য অজয় কুমার ভৌমিকের সাথে আলাপ করলে জানা যায়, ১৯৬৯ সালে গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে ঠিক তখন আবাল-বৃদ্ধ-বনিতাসহ সকল জনতা সেই আন্দোলনে শরীক হয়েছিলো। হাজীগঞ্জের রাজারগাঁও বাজারে জনতার গণমিছিলে তৎকালিন পাকিস্তানী পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষন করে। আর সেই গুলিতে রাজারগাঁও গ্রামে দু’কিশোর সম্পর্কে আপন চাচা-ভাতিজা জামাল ও কামাল সেদিন গুলিতে নিহত হয়। এ সংবাদ যখন সেদিন চাঁদপুর মহকুমার ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কাছে চলে আসে, সংবাদ পাওয়ার পর তৎকালীর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রবিউল আউয়াল কিরণ ও অজয় ভৌমিকের নেতৃত্বে বেশক’জন ছাত্রনেতাকে পাঠান। সেখানে তারা উপস্থিত হলে হাজারো মানুষের যেনো ঢল নামে। আর তখন পাকিস্তানী পুলিশ সদস্যরা ঢলের সামনে না দাঁড়াতে পেরে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ তখন মৃত জামাল ও কামালের লাশ চাঁদপুর মহকুমা অর্থাৎ বর্তমান চাঁদপুর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে নিয়ে আসে।
সেই রাতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ শোক মিছিলের প্রস্তাব এনে প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। এ কথা জানতে পেরে মহকুমা প্রশাসক ও পুলিশ জামাল ও কামালের লাশ দু’টো কর্ডন করে রাখে। যাতে করে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ লাশ নিয়ে শোক মিছিল বের করতে না পারে। কিন্তু পরদিন কলেজ মাঠে আবারো জনতার ঢল নামে। প্রশাসন তখন অসহায় হয়ে পড়ে। তাই তৎকালীন ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা করে প্রশাসন শোক মিছিল করার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। তখনই ছাত্রসংগ্রাম নেতৃবৃন্দ দাবি তুলেন প্রশাসনসহ সকলকে কালো ব্যাজ ধারণ করে মিছিলে অংশ নিতে। সকাল সাড়ে ১০টায় চাঁদপুর সরকারি কলেজ মাঠে শোকসভা শুরু হয়। সেদিন জনতার ভিড়। রূপান্তর হয় জনসমুদ্রে। এক পর্যায়ে শোকসভায় যোগ দিতে আসেন তৎকালীন চাঁদপুর সরকারি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুস সাত্তার। তিনি অনুভূতিতে বলেন, আজ থেকে আমরা সকল শিক্ষক এ আন্দোলনে মিলিত হলাম। এতে যদি জীবন ও চাকুরী চলে যায় আমরা আন্দোলনে পিচ্পা হবো না।
১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের জামাল ও কামালের শোক মিছিল শহর প্রদক্ষিণ করে। ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ছাত্রনেতৃবৃন্দের পক্ষে থেকে সকল নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া সত্ত্বেও বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা স্বাধীনতা বিরোধী ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ করে। পরে শহীদদেরকে শোক মিছিল শেষে পুনরায় কলেজ মাঠে এনে জামাল ও কামালের লাশ রাখা হয়। অজয় ভৌমিক আরো জানান, এ দু’টো লাশ পাকিস্তানী প্রশাসন কলেজ মাঠ থেকে রাজারগাঁওয়ে নিতে দেয়নি। এরপর চাঁদপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি মরহুম আব্দুল করিম পাটওয়ারী তখন নিজ উদ্যোগে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক রবিউল আউয়াল কিরণ, অজয় ভৌমিক, মরহুম মাহবুবুর রহমান পাটওয়ারী, অহিদুল হক, লতিফ মাওলানা, আব্দুর রহমানকে সাথে নিয়ে লাশ দু’টি বিষ্ণুদী আজিমিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে মরহুম করিম পাটওয়ারী নিজস্ব জায়গায় দাফনের ব্যবস্থা করেন।
সেদিন এ দু’কিশোরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিলো। কালের স্বাক্ষী হয়ে জামাল ও কামালের কবরটি পাটওয়ারী বাড়ির সে স্থানে রয়েছে। কিন্তু অযতœ আর অবহেলায় সে কবর দু’টি বিলুপ্ত হয়ে যাবার উপক্রম। এক সময় কবর দু’টির ছোট বাউন্ডারীতে পাথরে নাম লেখা ছিল। আজ সেটিও নেই। অজয় কুমার ভৌমিক প্রশাসনের কাছে আকুতি জানিয়ে বলেন, ১৯৬৯-এর গণ-আন্দোলনের এ দু’কিশোরের স্মৃতি চিহ্ন ধরে রাখতে কবর দু’টি যেনো সংস্কার করার মহতি উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়।