নাছির উদ্দিন আহম্মেদ বনাম শফিকুর রহমান ভূঁইয়া বাঘে সিংহে জোর লড়াই
চাঁদপুর প্রতিনিধি
মেঘনার এ অঞ্চলে ১১৮ বছরের ঐতিহ্যমন্ডিত চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নবগঠিত ও বর্ধিত ৩টি ওয়ার্ডসহ বিশাল ১৫টি ওয়ার্ডের গোটা এলাকা জুড়ে সর্বত্র চমৎকার নির্বাচনী আমেজপূর্ণ ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে মেয়র পদপ্রার্থীতা নিয়ে সচেতন নারী-পুরুষ তথা সর্বস্তরের সাধারণ ভোটারদের মাঝে ব্যাপক কৌঁতুহলীদ্দীপক এ উৎসাহ-উদ্দীপনার আমেজ যেন একটু বেশি। এছাড়া স্ব-স্ব প্রার্থীদের নেতা, কর্মী ও সমর্থক ভোটারদের মাঝেও বিরাজ করছে এক অজানা শিহরণপূর্ণ টান টান উত্তেজনা। কেননা বহু চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৫ বছর পর বহুল আলোচিত ও কাঙ্খিত এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। অর্থাৎ ২০০৬ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩ দফা চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও নানা আইনী জটিলতার প্রতিবন্ধকতায় শেষ পর্যস্ত নির্বাচন আর হয়নি। সর্বশেষ গত ১৫ ফেব্র“য়ারি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ঘোষিত ৪র্থ বারের নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী আগামী ২৯ মার্চ রোববার চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এবারের নির্বাচনে ১৪ দলীয় জোটের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ সমর্থিত ও মনোনীত সর্বগ্রহণযোগ্য একক প্রার্থী হিসেবে বর্তমান মেয়র আল্হাজ্ব মোঃ নাছির উদ্দিন আহম্মেদ মোবাইল প্রতীক বনাম ২০ দলীয় মহাজোটের নেতৃত্বাধীন বিএনপির পদ-পদবী ও কার্যক্রম থেকে সাময়িক স্থগিত প্রার্থী মোঃ শফিকুর রহমান ভূঁইয়া জগ প্রতীক নিয়ে মেয়র পদের জন্য নির্বাচনী মাঠে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতাপূর্ণ ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। এর নেপথ্য শানে-নূযুলের কারিশমায় বিএনপির চার প্রার্থী যথাক্রমে অ্যাডভোকেট সলিম উল্লাহ সেলিম, আক্তার হোসেন মাঝি, শাহজালাল মুন্সী ওরফে মিশন ও ইব্রাহিম কাজী জুয়েল এবারের পৌর নির্বাচনে দলীয় নির্দেশনায় আদিষ্ট হয়ে শেষ মুহুর্তে হলেও স্বেচ্ছায় তাঁদের স্ব-স্ব মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করায় নির্বাচনের জমজমাট প্রতিদ্বন্ধিতা বেশ নাটকীয় হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত এই দুই হট ফেভারিট প্রার্থীর মধ্যে তীব্র প্রতিদ্বন্ধিতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ায় নির্বাচনী মাঠে বাঘে সিংহে জোর লড়াই হওয়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ প্রতিবেদক গত এক সপ্তাহ চাঁদপুর পৌরসভাধীন নতুনবাজার এবং পুরানবাজারের ১৫টি ওয়ার্ডের অসংখ্য ন্রাী-পুরুষ তথা সর্বস্তরের সচেতন ভোটারদের সাথে কথা বলে নানা চমকপ্রদ তথ্য-উপাত্তের বিস্তারিত জানতে পারেন। এতে বেরিয়ে এসেছে অতীত কার্যকলাপের মজার মজার সব ফিরিস্তি।
আসন্ন চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনকে ঘিরে ইতোমধ্যে উভয় প্রার্থীর স্ব-স্ব নেতা, কর্মী ও সমর্থক ভোটারদের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে স্নœায়ুযুদ্ধ। দেখা দিয়েছে ব্যাপক ‘টাগ অব্ ওয়ার’-এর আশংকা। উভয় প্রার্থীর স্ব-স্ব সমর্থকরা আদাজল খেয়ে নির্বাচনী ভোটযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘাম ঝরিয়ে তাদের প্রার্থীকে জয়যুক্ত করতে ব্যাপক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রার্থীরাও এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে নির্বাচনী মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন। যেন বহুল আলোচিত দীর্ঘ দিনের একে অপরের চির প্রতিপক্ষ দু’টি নাম-আল্হাজ্ব মোঃ নাছির উদ্দিন আহম্মেদ বনাম মোঃ শফিকুর রহমান ভূঁইয়া। আজন্ম বিপরীত রাজনৈতিক মেরুতে বিশ্বাসী হলেও এবারের নির্বাচনে মেয়র পদপ্রার্থী হিসেবে উভয়ে উভয়ের একমাত্র প্রতিদ্ব›িদ্ধ। ইতিপূর্বে ২০০৬ সালে চাঁদপুর পৌরসভার নির্বাচনেও তাঁরা একে অপরের অন্যতম প্রতিদ্ব›িদ্ধ ছিলেন। সেই সময় চেয়ারম্যান শফিক ভূঁইয়াকে পরাজিত করে নাছির উদ্দিন আহম্মেদ চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন এবং চেয়ারম্যান থাকাকালে ২০০৮ সালে তিনি চাঁদপুর পৌরসভার প্রথম মেয়র হিসেবে দায়িত্বভার লাভ করেন।
সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান মেয়র হিসেবে দু’জনই চাঁদপুরবাসীর কাছে হেভিওয়েট বা হট ফেভারিট প্রার্থী। বিভিন্ন কারণে উভয়েরই রয়েছে শক্তিশালী অবস্থান এবং ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনসমর্থন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান থাকাকালে শফিক ভূঁইয়া পৌরসভা ও অন্যান্য কার্যালয়ের বা বিভাগের ঠিকাদারী কাজের মাধ্যমে চাঁদপুর পৌরসভার সাবেক ১২টি ওয়ার্ডের যুব সমাজের মাঝে ওয়ার্ডভিত্তিক ক্ষেত্র তৈরি করতে সক্ষম হন। নানাকারণে তিনিও দলের কাছে পরীক্ষিত হয়ে কেন্দ্রীয় বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যপদ (পরবর্তীতে পদ ও কার্যক্রম স্থগিত) লাভ করেন। সাবেক চেয়ারম্যান এবং আজন্ম বিএনপিমনা হিসেবে তাঁরও যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। রয়েছে বিএনপির প্রচুর সমর্থক ভোটার। সেই সাথে তাঁর ব্যক্তিগত সমর্থিত বিএনপির অনেক নেতা, কর্মী ও সমর্থক রয়েছেন তাঁর সাথে। এছাড়া স্থানীয় বিএনপির প্রতিপক্ষ একাধিক গ্র“পের মূল দল বিএনপি এবং তাদেরকে অনুসরনকারী অঙ্গ দলগুলোর বেশকিছু নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা তাঁকে (শফিক ভূঁইয়াকে) তলে তলে গোপনে হটলাইন রেখে সমর্থন যুগিয়ে চলেছেন। এমনকি চেয়ারম্যান থাকাকালে শফিক ভূঁইয়া চাঁদপুর পৌরসভার অন্তর্গত বেশকিছু হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবারকে জায়গা-সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়সহ নানাভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। চাঁদপুর পৌরসভার নবগঠিত ও বর্ধিত ৩টি ওয়ার্ড যথাক্রমে ১৩, ১৪ ও ১৫নং ওয়ার্ডগুলো সাবেক ইউনিয়নের অন্তর্গত হওয়ায় এখানেও(গ্রামগুলোতেও)প্রচুর বিএনপির সমর্থক রয়েছে। সকল বিএনপির সমর্থকরা শফিক ভূঁইয়াকে বিএনপির প্রার্থী মনে করে বা বিএনপির প্রার্থী ভেবে ভোট দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আর্থিকভাবে নিজেও একজন কোটিপতি। এসব কারণে শফিক ভূঁইয়া অনেক ভোট পাবেন এবং নির্বাচনে শক্ত প্রতিদ্ব›িদ্ধতা গড়ে তুলতে সক্ষম হবেন বলে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
পক্ষান্তরে আল্হাজ্ব মোঃ নাছির উদ্দিন আহম্মেদ প্রথমে চেয়ারম্যান এবং পরবর্তীতে মেয়র হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভার ১১৮ বছরের ইতিহাসে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দুই শ’ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ করার অবিস্মরণীয় রেকর্ড গড়েন। বাংলাদেশের একটি মডেল পৌরসভা হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভাকে দেশে-বিদেশে বিশেষভাবে পরিচিত করান। বর্তমানে রানিং মেয়র এবং আজন্ম আওয়ামীলীগার হিসেবে তাঁরও যথেষ্ট পরিচিতি রয়েছে। রয়েছে আওয়ামীলীগের প্রচুর সমর্থক ভোটার। সেই সাথে তিনি দীর্ঘদিন যাবত চাঁদপুর পৌর আওয়ামীলীগের সফল সভাপতি হিসেবে চাঁদপুর পৌরসভার ১৫টি ওয়ার্ডেই দলীয়ভাবে একটি শক্তিশালী অবস্থান ও ক্ষেত্র তৈরি করতে অনায়াসে সক্ষম হন। এমনকি চাঁদপুরের সর্বস্তরের সচেতন নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে গঠিত‘ নাগরিক কমিটি’ও চাঁদপুর পৌরসভায় তাঁর স্মরণকালের উন্নয়নের জন্য তাঁকে শতভাগ সমর্থন জানিয়েছেন। এছাড়াও চাঁদপুর পৌরসভায় স্মরণকালের উন্নয়ন করার প্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ সচেতন নাগরিকদের কাছে তথা সর্বস্তরের সাধারণ ভোটারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোপরি চাঁদপুর জেলায় ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগের অভ্যস্তরে দীর্ঘ ৬ বছর যাবত যে দ্বন্ধ ও কোন্দল ছিল; দলীয়ভাবে তাঁকে একক মনোনয়ন প্রধানকে কেন্দ্র করে দলের সকল গ্র“পিং আপাততঃ এক ও ঐক্যবদ্ধ হয়। তাছাড়া শাসক দলের রয়েছে প্রচুর অর্থ। এসব কারণেও নাছির উদ্দিন আহম্মেদ একচেটিয়াভাবে প্রচুর ভোট পাবেন। চাঁদপুর পৌরবাসী অত্যন্ত সচেতন। তারা সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে ভোট দিতে কখনো ভুল করেন না। অতীতে তার অনেক নজির রয়েছে। আসন্ন নির্বাচনেও তার বাস্তব প্রতিফলন ঘটবে বলে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন।
এছাড়া রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিকসহ নানা হিসাব-নিকাশের চুলচেরা বিশ্লেষণের সূক্ষ্ম সমীকরণে শেষ পর্যন্ত যে উভয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিদ্ব›িদ্ধতাপূর্ণ ‘বাঘে সিংহে জোর লড়াই’ হবে ; এ কথা অন্ততঃ আগে ভাগে নিশ্চিত করেই বলা যায়। সেই সাথে এই দুই শক্তিশালী প্রার্থীর সমর্থকরা স্ব-স্ব প্রার্র্থীর জয়লাভে শতভাগ আশাবাদী। দেখা যাক, আসন্ন চাঁদপুর পৌরসভা নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত ‘বাঘ বিড়াল হয়(!)’ নাকি ‘সিংহ শিয়াল হয়(!)’; এখন তা-ই দেখার অপেক্ষায় সচেতন চাঁদপুরবাসী।