ঢাকা: একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। আদেশে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হয়। বুধবার সোয় ১২টার দিকে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ বহুল প্রতিক্ষীত এ রায় ঘোষণা করেন। নিজামীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগের মধ্যে আটটি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে চারটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া বাকি চার অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এর আগে বেলা ১১টা ৭ মিনিটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ২০৪ পৃষ্টার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়া শুরু হয়। শুরুতেই ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, ‘আমরা অপেক্ষায় ছিলাম কবে রায় দিতে পারবো। এ জন্য অনেকে অনেক কথাই বলেছেন। ন্যায় বিচার ও আইনের শাসনের কথা আদালত বলতে পারেন, অন্য কেউ বলতে পারে না। আমরা টক-শো কিংবা রাস্তায় আদালতের বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারি না। মন্তব্য করার সময় আমাদেরকে জবাবদিহির কথা মনে রাখতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদেরকে অনেকেই অভিযুক্ত করেন রায়ের ব্যাপারে ওপর থেকে নির্দেশ আসে। কিন্তু না আইন ও সংবিধান দেখেই রায় দেয়া হয়।’ এরপর রায় পড়া শুরু করেন বিচারপতি আনোয়ারুল হক। এর আগে বেলা ১১টায় বিচারপতিরা এজলাসে প্রবেশ করেন। প্রায় একই সময় নিজামীকে ট্রাইব্যুনাল-১ এর কাঠগড়ায় নেয়া হয়। তারও আগে বুধবার সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে তাকে প্রিজন ভ্যানে করে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। তবে কাঠগড়ায় ওঠানোর আগে হাজতখানায় নিজামীকে বেশ চিন্তিত দেখা গেছে। মুখে হাত দিয়ে বসা ছিলেন তিনি। নিজামীর এ রায়ের জন্য অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের উদ্যোগে মুক্তিযোদ্ধারা ফাঁসির দাবিতে ব্যানার নিয়ে ট্রাইব্যুনালের সামনে মানবন্ধন করেন। এর আগে গতকাল মঙ্গলবার নিজামীর মামলার রায় ঘোষণার জন্য বুধবার দিন ধার্য করা হয়। উল্লেখ্য, গত ২৪ জুন এ মামলার রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য থাকলেও আসামি মতিউর রহমান নিজামী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে আদালতে উপস্থিত করা হয়নি। এ কারণে রায় পিছিয়ে চতুর্থবারের মতো অপেক্ষমাণ রাখা হয়। গত বছরের ১৩ নভেম্বরও অপেক্ষমান (সিএভি) রাখা হয়েছিল মামলাটি। সেদিন আসামিপক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থানের দিন ধার্য থাকলেও হরতালের কারণে না আসায় সময় আবেদন খারিজ করে মামলার কার্যক্রম শেষ করে দেন ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২০ নভেম্বর উভয়পক্ষের আইনজীবীদের সমাপনী বক্তব্য শেষে রায় অপেক্ষমান রাখেন আদালত। নিজামীর বিরুদ্ধে একাত্তর সালে পাবনার বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগসহ মোট ১৬টি অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব অভিযোগের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়রে ওপর এবং ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এসব অপরাধ কখনো তার নির্দেশে আবার কখনো তার আদেশে সংগঠিত হয়েছে। এর আগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল যেসব রায় দেন- জামায়াতের সাবেক রুকন আবুল কালাম আযাদকে হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ এবং অগ্নিসংযোগের ৮টি অভিযোগের ৪টিতে মৃত্যুদণ্ড, ৩টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর থেকেই তিনি পলাতক। তার অনুপস্থিতিতেই এ রায় দেয়া হয়। জামায়াতের আমির গোলাম আযমকে ৯০ বছর নিরবচ্ছিন্ন কারাদণ্ড দেয়া হয়। জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। সহকারী সেক্রেটারি মুহাম্মদ কামারুজ্জামানেরও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মৃত্যুদণ্ড, আরেক নেতা আব্দুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ড। নিউইয়র্কে অবস্থানরত জামায়াতে নেতা আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ড এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত আরেক নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীনেরও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে হত্যা, গণহত্যা ও ধর্ষণের ৬টি অভিযোগ ৩টিতে ১৫ বছরের কারাদণ্ড, ২টিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১টিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এখন পর্যন্ত তার রায়ই কার্যকর করা হয়েছে। প্রসঙ্গত, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় গত ৩০ জানুয়ারি মতিউর রহমান নিজামীসহ ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন চট্টগ্রামের একটি আদালত।