দীর্ঘদিনেও শরিকদের নিয়ে একসঙ্গে পথ চলার লক্ষ্য স্থির করতে পারছে না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। জোটভুক্ত দলগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাটছেই না। নেতাদের ভেতর আস্থার সংকট তীব্র। কেউ কাউকে বিশ্বাস করেন না। সিদ্ধান্ত নিয়েও পারেন না স্থির থাকতে। এসব কারণে কোনো কর্মসূচি জোরালোভাবে মাঠে গড়ায়নি। অথচ ভোটের আগে ও পরে ফ্রন্টের নেতারা বিভিন্ন সময় প্রায় সব বিষয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন।
জনগণকে শুনিয়েছেন আশার কথা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই কাজে আসেনি। জোটের শরিকদের প্রায় কেউ মাঠেই নামেনি। ফলে নির্বাচনের পর থেকে এখন পর্যন্ত সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না বিশিষ্ট আইনজীবী ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। কয়েক দফা বৈঠক করেও কাক্সিক্ষত ফল মেলেনি। ঐক্য সুসংহত করে, জোটের পরিধি বাড়িয়ে, সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে রাজপথে নামার ঘোষণাও বাস্তবায়িত হয়নি। তর্জন-গর্জন সবই প্রায় থেমে যাওয়ার পথে। এখন নিজেরাই অনেকটা অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে।
তবে এ সংকট সাময়িক বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি অর্থবহ নির্বাচন চেয়েছি। মানুষের ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনের আগে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এক সঙ্গে নির্বাচনও করেছি। কিন্তু ভোটের নামে যা হল তা কারও কল্পনায়ও ছিল না। ভোটাধিকার নিয়ে এতবড় প্রহসন- এর আগে কখনও এ দেশে ঘটেনি। স্বভাবতই এ ঘটনা আমাদের জাতীয় জীবনে একটি বড় ধাক্কা। এ ধাক্কা সামলিয়ে উঠে নতুন করে পথ চলতে একটু তো সময় লাগবেই।’
তিনি আরও বলেন, ‘এ অবস্থা থেকে উত্তরণে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের ঐক্যকেও সুসংহত করতে হবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দিতে বর্তমান সরকারকে বাধ্য করতে হবে।’ ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘নির্বাচনের পর আমরা কয়েক দফা বৈঠক করেছি। আরও বসব। আমরা সবাই মিলে আমাদের পরবর্তী করণীয় ঠিক করব।’ তিনি বলেন, বর্তমান সরকার কিভাবে ক্ষমতায় আছে দেশের মানুষ তা জানে। তারা একটি অর্থবহ পরিবর্তন চায়। এ চাওয়া আগেও ছিল, কিন্তু পূরণ হয়নি। আগামীতে যাতে আমরা মানুষের চাওয়া পূরণ করতে পারি, সে লক্ষ্যে কর্মসূচি ঠিক করা হবে।’
বিএনপিসহ পাঁচটি রাজনৈতিক দল নিয়ে ভোটের আগে যাত্রা শুরু হয় সরকারবিরোধী এ জোটের। কিন্তু ভোটে নজিরবিহীন ভরাডুবির পর মুখ থুবড়ে পড়েছে তাদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড। শরিক দলের নেতারা অভিযোগ করেন, জোটের শরিক দলগুলোর শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতির সঙ্গে বাস্তব অবস্থার তেমন মিল নেই। নেতারা এক ধরনের বক্তব্য দেন, কর্মীরা সে অনুযায়ী চলেন না। ফলে জোট ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এর পেছনের কারণ হচ্ছে, একে অপরের প্রতি সন্দেহ-অবিশ্বাস। কেউ কাউকে সেভাবে বিশ্বাস করছেন না বলেই এগোতে পারছে না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ঐক্যফ্রন্টের শরিক একটি দলের নেতা বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও নির্বাচনের অংশ হিসেবে ভোটের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গড়ে উঠলেও শুরু থেকেই এ জোটে সমন্বয়হীনতা ছিল। ছিল আস্থার সংকট। নেতারা এক মঞ্চে বসলেও কেউ কাউকে বিশ্বাস করতেন না। এমনকি কোনো সিদ্ধান্ত নিয়েও স্থির থাকতে পারতেন না। বিশেষ করে আসন ভাগাভাগি, জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপির আসন ছাড় দেয়া- এসব ইস্যুতে ভোট চলার সময়ই সংকট তৈরি হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। নির্বাচনের পর এ সঙ্কট আরও বাড়তে থাকে শপথ নেয়া-না নেয়াকে কেন্দ্র করে। আর এসব কারণে কর্মসূচি দিয়েও শেষ মুহূর্তে পিছু হটে তারা।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দলের আরেক নেতা বলেন, নির্বাচনের পর শপথ নেয়ার পক্ষে অবস্থান নেন ড. কামাল হোসেন। তখন বিএনপিসহ অন্যরা তার ওপর চাপ প্রয়োগ করেন যাতে তারা শপথ না নেন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আবার বিএনপিই শপথ নেয়। এতে ক্ষুব্ধ হন ড. কামাল হোসেন। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সখ্যের ঘটনায়ও ক্ষুব্ধ তিনি। এ অবস্থায় আগামী দিনে বিএনপিকে নিয়ে পথচলায় একটি সুনির্দিষ্ট অবস্থান চান ড. কামাল হোসেন। তার সঙ্গে একমত পোষণ করেন কাদের সিদ্দিকীও। আবার বিএনপি তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চায়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিকরা শুধু খালেদা জিয়া ইস্যুতে রাজপথে নামতে নারাজ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক চার দলের শীর্ষ নেতারাই মনে করেন জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে রাজপথে থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এর আগে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যও ঠিক করতে চান তারা। এজন্য নির্বাচনের আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ঘোষিত দাবি এবং লক্ষ্যগুলো প্রয়োজনে আরও সংশোধন-সংযোজনও করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরছে শরিকরা। তারা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ ভবিষ্যতে একসঙ্গে পথ চলার কর্মকৌশল ঠিক করতে হবে আগে। পাশাপাশি নির্বাচন পরবর্তী সময়ে নানা ইস্যুতে জোটের ভেতরে তৈরি হওয়া দূরত্ব, মান-অভিমান এবং টানাপোড়েন দূর করে নতুন করে পথ চলার লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। মান ভাঙাতে হবে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি কাদের সিদ্দিকীর।
জানা গেছে, কাদের সিদ্দিকী তার অবস্থানে অনড়। ড. কামাল হোসেনের অনুরোধে তিনি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিতে সময় নিচ্ছেন। বিএনপিও আছে সংকটে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট না বিশ দলীয় জোট- কাকে বেশি প্রাধান্য দেবে- এ নিয়েও দলটির ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছে। ঘর ও জোট সামলাতে ব্যস্ত বিএনপি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ড. কামাল হোসেনের কিছু দাবি। তিনি জামায়াতে ইসলামী ইস্যুতে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করার দাবি জানিয়ে আসছেন নির্বাচনের সময় থেকেই। এসব নিয়ে এক ধরনের লেজেগোবরে অবস্থা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে।
অভ্যন্তরীণ সংকট দূর করতে এবং জোটের ভাঙন ঠেকাতে দীর্ঘদিন পর ১১ জুন জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রবের উত্তরার বাসায় বৈঠক করেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। যদিও এ বৈঠকে জোটের দুই শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ছিলেন না। তাদের অনুপস্থিতিতে দীর্ঘ ৩ ঘণ্টা বৈঠক চললেও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়। নিজেদের মান-অভিমান এবং দূরত্ব কমিয়ে আনার উদ্যোগও খুব একটা কাজে আসেনি এ বৈঠকে। এ অবস্থায় কথা হয়, জোটের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেনের উপস্থিতিতে আবারও বৈঠকে বসার। কিন্তু এ বৈঠকও এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়নি।
এর আগে ৪ জুন আ স ম আবদুর রবের বাসায় বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ বৈঠকে কাদের সিদ্দিকীর জোট ছাড়ার আলটিমেটামসহ সামগ্রিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। এরও প্রায় ২ মাস আগে অর্থাৎ ৫ মার্চ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতাদের। ওই বৈঠকেও ড. কামাল হোসেন অনুপস্থিত ছিলেন। তার অনুপস্থিতিতেই ২৮ মার্চ শাহবাগে মানববন্ধন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেয়া হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এ কর্মসূচি বাতিল করা হয়। কেন তা বাতিল করা হল- তার কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এর আগে ফেব্রুয়ারিতে বিভাগীয় শহরে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েও তা বাতিল করেন তারা।
সাত দফা দাবি ও ১১ দফা লক্ষ্য সামনে রেখে ২০১৮ সালের ১২ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। বিএনপি, গণফোরাম, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) এবং নাগরিক ঐক্য- এ চার দল মিলে সরকারবিরোধী জোটের যাত্রা শুরু হয়। এর কিছু দিন পর সম্পৃক্ত হয় কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। পরে পাঁচ দল মিলে ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। নির্বাচনে বিএনপির ছয়জন এবং গণফোরামের দু’জনসহ আটজন জয়ী হন। যদিও তারা এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেন এবং শপথ না নেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। পাশাপাশি পুনর্নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের ঘোষণা দেন।
কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বাদে দলটির পাঁচজনই শপথ নেন। এর আগে গণফোরাম থেকে নির্বাচিত দু’জন দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে শপথ নেন। আর এ নিয়েই মূলত ভোটের পর টানাপোড়েন তৈরি হয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে। শপথ না নেয়ার ঘোষণা দিয়েও শেষ মুহূর্তে বিএনপির শপথ নেয়া, আবার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের শপথ না নেয়ার ঘটনায় ক্ষুব্ধ হন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম শরিক কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ সভাপতি কাদের সিদ্দিকী। তিনি এ বিষয়ে চিঠি দিয়ে ব্যাখ্যা চান জোটের শীর্ষ নেতাদের কাছে। যুতসই ব্যাখ্যা না পেলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছাড়ার ঘোষণা দেন কাদের সিদ্দিকী। জেএসডি এবং নাগরিক ঐক্যও ক্ষুব্ধ এসব ঘটনায়।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক দল জেএসডির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক রতন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে- নির্বাচন নেই, কর্মসূচিও নেই, কর্মকাণ্ডও নেই। এর মূল কারণ, আমরা এখনও আমাদের লক্ষ্য ঠিক করতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘দু-একটি বৈঠক হলেও তা খুব একটা ফলপ্রসূ হয়নি। আসলে আমাদের এ-টু-জেড ঐক্য গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে এ সরকারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলনই সফলতা পাবে না।’ আবদুল মালেক রতন বলেন, একটি প্রবাদ আছে- ‘যত গর্জে তত বর্ষে না।’ আমরা কথা বলছি, কাজের কাজ এখনও কিছু করতে পারছি না- এটাই বাস্তবতা। আর এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে কৌশল ঠিক করতে হবে।’