নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রচারের সময় শেষ হচ্ছে আজ শুক্রবার। আর এক দিন পরেই ভোটগ্রহণ। ফলে এখন ভোটের অঙ্ক মেলাতে ব্যস্ত মেয়র পদে মূল দুই প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিনা হায়াত আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকারের নির্বাচনী শিবির। সিটি করপোরেশনের ২৭টি ওয়ার্ডের কোনটিতে নিজেরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন, কোনটিতে পিছিয়ে আছেন, তার তথ্য বিশ্লেষণ করছে দুই পক্ষই।
আওয়ামী লীগের প্রার্থী আইভীর নির্বাচন পরিচালনায় সহযোগিতার জন্য গতকালও কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ চার নেতা নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করেন। তাঁরা হলেন—আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও আব্দুর রহমান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম। এ ছাড়া ২৭টি ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত ১৬ কেন্দ্রীয় নেতাও ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে গণসংযোগ করেন।
গতকাল সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, আবদুর রহমান ও বাহাউদ্দিন নাছিম। তাঁরা জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ ও পুলিশ সুপার জায়েদুল আলমের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে নানক সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসেছিলাম জেলা প্রশাসক ও এসপি মহোদয়কে এ কথাটা বলার জন্য, যেকোনো কিছুর বিনিময়ে একটি শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যপূর্ণ নির্বাচন করতে হবে। এর আগেও আমি বারবার এসেছিলাম।’
নানক বলেন, ‘এখানে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। আমরা আজকে এখানে কোনো গোপন বৈঠক করিনি। এখানে লুকোচুরির কোনো বিষয় নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, নির্বাচনটি অত্যন্ত শান্তিপূর্ণ, আনন্দ উৎসব ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হবে।’
তবে এই বৈঠক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকারের সন্দেহ, প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে গিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। তিনি বলেন, ‘তাঁরা তো নারায়ণগঞ্জের ভোটার না, তাঁরা এইখানে আসে কেন? তাঁরা ডিসি অফিসে বসে প্রশাসন-পুলিশে প্রভাব বিস্তার করে আমার লোকজনের বাড়িতে বাড়িতে লোক পাঠাইতেছে, আর আমার লোকজনরে গ্রেপ্তার করতাছে, ভয় দেখাইতেছে।’
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, সাতটি ওয়ার্ডে নৌকার প্রার্থী কিছুটা পিছিয়ে আছেন বলে মনে করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা। এই ওয়ার্ডগুলো হলো ১, ২, ৩, ১১, ১২, ১৩ ও ২৭। এসব ওয়ার্ডে মূলত দুই কারণে নৌকা পিছিয়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রথমত, এখানে বেশ কয়েকটি মাদরাসা রয়েছে। ফলে এসব এলাকায় হেফাজতে ইসলামের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। তাদের নেতাকর্মীরা ভোটের মাঠে বরাবরই নৌকার বিরুদ্ধে কাজ করেন। দ্বিতীয়ত, এসব ওয়ার্ডে দলের মধ্যেও কোন্দল রয়েছে। একাধিক ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন। ফলে তাঁরা মেয়র প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন না।
বিগত নির্বাচনে ১ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডে বিএনপির প্রার্থীর চেয়ে কম ভোট পান আইভী। নগরীর সরদারপাড়ার অংশ, নিউ খানপুর, মজিদ খানপুর, ইসদাইর, মিশনপাড়া, উত্তর চাষাঢ়া নিয়ে গঠিত ১২ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডে টানা তিনবারের কাউন্সিলর বিএনপি নেতা শওকত হাশিম। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা কালের কণ্ঠকে জানান, শওকত বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় দণ্ডিত ক্যাপ্টেন কিসমতের ভাই। ফলে এই ওয়ার্ডে আইভীর প্রতিদ্বন্দ্বী তৈমূর বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছেন।
কয়েকটি ওয়ার্ডে খারাপ অবস্থা থাকলেও তা নৌকার জয়ের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা। তাঁরা মনে করেন, অন্য ওয়ার্ডগুলোতে আইভী বড় ব্যবধানে এগিয়ে থাকবেন।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ ক্লাবে কথা হয় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সব ওয়ার্ডে তো আর আমরা সমান ভোট পাব না। দু-চারটি জায়গায় ভোট কম-বেশি হবে। তবে নৌকা প্রতীক লক্ষাধিক ভোটের ব্যবধানে জয় পাবে বলে আশা করছি।’
বড় জয়ের আশা করছেন তৈমূরও
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যখন আইভীর পক্ষে নির্বাচনের মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন তৈমূর আলম খন্দকারের ভরসা স্থানীয় নেতাকর্মীরা। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে নিজের হাতি প্রতীকের নির্বাচনী কাজ চালাচ্ছেন তৈমূর।
তৈমূরের নির্বাচন পরিচালনায় যুক্ত একাধিক বিএনপি নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ছয়টি ওয়ার্ডে নৌকা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। এসব ওয়ার্ড হচ্ছে—১৪, ১৫, ১৬, ১৮, ২১ ও ২২। ওয়ার্ডগুলোতে নৌকার সুবিধাজনক অবস্থানের কারণ হলো—এই এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটার বেশি। আবার সেলিনা হায়াত আইভীর বাড়িও এখানে। ফলে এসব ওয়ার্ডে তাঁর বিশেষ জনপ্রিয়তা রয়েছে। ২১ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডে জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এ কে এম আবু সুফিয়ানের প্রভাব রয়েছে। তিনি আইভীর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
ছয়টি ওয়ার্ড বাদে সিটি করপোরেশনের অন্য ২১টি ওয়ার্ডে হাতি প্রতীক খুবই ভালো অবস্থানে রয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিএনপি নেতারা। তাঁরা মনে করেন, সুষ্ঠু ভোট হলে হাতি প্রতীক বড় ব্যবধানে জয় পাবে।
জানতে চাইলে মেয়র প্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি শুধু চাই একটি সুষ্ঠু ভোট। জনগণ ভোট দিতে পারলে আমি বড় ব্যবধানে জয় পাব।’
তুমুল লড়াই হবে, ধারণা ভোটারদের
১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় ভোটে সেলিনা হায়াত আইভী ও তৈমূর আলম খন্দকারের মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতা হবে বলে মনে করেন সাধারণ ভোটাররা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের নয়াপাড়া, মধ্য কদমতলী, কলেজপাড়া, ফকিরপাড়া, উত্তরপাড়া, গ্যাসলাইন এলাকা নিয়ে ৭ নম্বর ওয়ার্ড গঠিত। সিদ্ধিরগঞ্জের দক্ষিণ কদমতলী এলাকায় ইকবাল মিয়ার সঙ্গে তাঁর চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এইবার সেয়ানে সেয়ানে লড়াই হইবো।’ এ সময় পাশে থাকা আব্দুল মতিন বলেন, ‘যেই অবস্থা বুঝতাছি, তাতে হাতি মার্কার প্রার্থী ভালো ভোট পাইবো। হাতি মার্কার চোরা ভোট আর ডুবা ভোট আছে। ভোটের দিন ওরা ঠিক জায়গাতেই ভোটটা দিব।’
সিদ্ধিরগঞ্জের আদমজী, বিহারি কলোনি, সোনামিয়া বাজার, শিমুলপাড়া, গোদনাইল, বাগপাড়া, এসও রোড, নতুন আইলপাড়ায় ভোটারদের সঙ্গে কথা হয়। ৬ নম্বর ওয়ার্ডের মুরাদ হোসেন বলেন, ‘কাউরে ফালাইয়া দেওয়া যাইবো না। তবে এই ওয়ার্ডে আগে থেকেই নৌকার অবস্থান একটু ভালো। তবে হাতি মার্কাও কম ভোট পাইবো না।’
সিদ্ধিরগঞ্জের গোদনাইল, বার্মাশীল, পাঠানটুলী, রসুলবাগ, লক্ষ্মীনারায়ণ, আরামবাগ এলাকা নিয়ে গঠিত ১০ নম্বর ওয়ার্ডে কথা হয় ভোটার ফারুক হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এই ওয়ার্ডে কঠিন লড়াই হবে। কে জেতে, কে হারে তা বলা মুশকিল।