ঢাকা: দেশের বিভিন্ন এরাকায় জামায়াতের স্থানীয় নেতারা আওয়ামী লীগে যোগ দিচ্ছেন। আওয়ামী লীগও তাদের সাদরে গ্রহণ করছে। বিপরীত ধারার এই দুই রাজনৈতিক দলের গ্রহণ-বর্জনে প্রশ্ন উঠেছে, আওয়ামী লীগ কি তাহলে জামায়াত পুনর্বাসনের কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ইস্যুতে গোটা জাতি যখন ঐক্যবদ্ধ, তখন অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের দলে পুনর্বাসিত করছে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে যুদ্ধাপরাধের দায়ে জামায়াতের রাজনীতি যখন নিষিদ্ধের শেষ পর্যায়ে, সেই মুহূর্তে আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, জামায়াতের বিচার এখনই সম্ভব নয়।
সম্প্রতি গোপালগঞ্জ, পাবনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল, শরীয়তপুর, রাজশাহীতে জামায়াতের অনেক নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে ঠাঁই পেয়েছেন। সর্বশেষ বুধবার ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা জামায়াতের সাবেক সভাপতি আবু বক্কর খান শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমুর হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন।
জানা যায়, গত ১৯ এপ্রিল গোপালগঞ্জ জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ইসমাইল হোসেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম এ নাসির আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দিনের হাত ধরে আওয়ামী লীগের যোগদান করেন।
১৮ এপ্রিল পাবনার ঈশ্বরদীতে একটি ইউনিয়নের ৭০ জন নেতাকর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৬ মার্চ পাবনার সদর আসনের সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম ফারুক খন্দকার প্রিন্সের হাতে হাত ধরে পাবনার আতাইকুলা ইউনিয়ন জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা রাজ্জাক হোসেন, রোকন মাওলানা ফরিদ হোসেন, ম উদ্দিন শেখ, মাওলানা আজিজ, মাওলানা উজ্জ্বলসহ জামায়াত-শিবিরের দুই শতাধিক কর্মী-সমর্থক আওয়ামী লীগে যোগ দেন।
১৭ ফ্রেব্রুয়ারি বরিশালের গৌরনদীতে আওয়ামী লীগের সহসম্পাদক ও অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালক বলরাম পোদ্দারের হাত ধরে জামায়াত নেতা আল হেলাল একাডেমির চেয়ারম্যান ও ইসলামী উন্নয়ন পরিষদের উপদেষ্টা আবু জাফর শরীফ যোগ দেন আওয়ামী লীগে।
তৃণমূল নেতাদের পাশাপাশি একই কাজ করছেন দলের কেন্দ্রীয় ও প্রভাবশালী নেতারাও। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ায় জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নওশের আলী আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে যোগ দেন আওয়ামী লীগে। তখন বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন হানিফ।
এর আগে শরীয়তপুরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হকের হাত ধরে জামায়াত নেতারা আওয়ামী লীগে যোগদান করেন।
সর্বশেষ গত বুধবার ঝালকাঠি জেলার নলছিটি উপজেলা জামায়াতের সাবেক সভাপতি আবু বক্কর খান শিল্পমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য আমির হোসেন আমুর হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে নিজেকে আওয়ামী লীগে অন্তর্ভুক্ত করেন।
জামায়াতের নেতাকর্মীদের ফুলের মালা দিয়ে আওয়ামী লীগে ঠাঁই দেয়া নিয়ে জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সংগঠনের নেতাকর্মীদের আওয়ামী লীগে সাদরে গ্রহণ করায় সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
এরই মধ্যে শুক্রবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য অভিযুক্ত সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা এখনই সম্ভব নয়। যে আইনের অধীনে সংগঠনটির বিচার হওয়ার কথা, সেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধিগুলো জামায়াতের বিচারের জন্য যথেষ্ট নয়।
সরকারের সঙ্গে জামায়াতের সমঝোতার চেষ্টা চলছে বলে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুঞ্জনের শুরু অনেক দিন আগে থেকেই। বিশেষ করে জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিল বিভাগের রায়কে ঘিরে সরকারের সঙ্গে তাদের সমঝোতার বিষয়টি ব্যাপক আলোচিত হচ্ছে। বর্তমানে মিডিয়ার সঙ্গে জামায়াতের নেতাদের যোগাযোগ না রাখা এবং রাজনৈতিক ময়দানেও তাদের নীরবতা এ গুজব-গুঞ্জনের ডালপালা বিস্তৃত করছে।
তবে জাময়াত সব সময়ই সরকারের সঙ্গে তাদের সমঝোতার বিষয়টি অস্বীকার করে আসছে। আওয়ামী লীগে নেতাকর্মীদের যোগদানের বিষয়ে জামায়াতের বক্তব্য হলো, এসব বিছিন্ন ঘটনা।
এদিকে আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘‘আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্যে বিচারের ব্যাপারে মানুষের কাছে ভুল সংকেত যাচ্ছে৷ জামায়াতের প্রশ্নে সরকার যদি কোনো ধরনের ছাড় দেয়ার চেষ্টা করে, তবে তা আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হবে৷”
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে বিএনপি-জামায়াত সারা দেশে যে নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালায় এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে যে মামলা হয়, তা থেকে বাঁচতে জামায়াত অভিনব এক কৌশল অবলম্বন করেছে। এই কৌশলের অংশ হিসেবে জামায়াতের তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের হাতে ফুলের তোড়া দিয়ে আওয়ামী লীগে যোগদান করছেন।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী এ বি এম তাজুল ইসলাম নতুন বার্তা ডটকমকে বলেন, “একটি সংগঠন বা দলে নতুন করে কেউ যোগ দিতেই পারে। যারা দল গঠন করে, শুধু তাদের দিয়েই তো আর দল সারা জীবন চলতে পারে না। কিন্তু সে ক্ষেত্রে বিষয়টা নির্ধারণ করবে তৃণমূল। যারা আওয়ামী লীগের যোগ দিচ্ছে তারা আদর্শের কারণে দলে আসছে নাকি সুবিধাবাদী হিসেবে দলে ভিড়ছে, তা জানতে হবে। আর এটা সবচেয়ে ভালো জানে তৃণমূল।”
তাজুল ইসলাম বলেন, “কেন্দ্রীয় নেতার হাত ধরে নয়, তৃণমূলের নেতারা যদি মনে করেন, তবে তাদের হাত ধরেই যে কেউ দলে যোগ দিতে পারেন।”