কালীম মাহফুজ
এক রেস্টুরেন্ট মালিকের গল্প দিয়েই শুরু করছি। সুদানের বাসিন্দা তিনি। শহরতলিতে তার দোকান। দোকান ছোট হলেও খাবার মানসম্মত। পরিবেশনা রুচিশীল। তাই ব্যবসাও চলছে ভালো।
এক সন্ধ্যার ঘটনা। রাতের জন্য খাবার দাবার প্রস্তুত। মহাজন সাহেব কিছুটা নির্ভার। নিজ আসনে গা এলিয়ে বসে আছেন। হঠাৎ ঝড় তুফান শুরু হলো। সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার উপক্রম। সঙ্গে ঝুম বৃষ্টি। স্বভাবতই এ সময় বিদ্যুৎ থাকার কথা নয়। এলাকাজুড়ে অন্ধকার ছেয়ে গেছে। মহাজন লো ভোল্টেজের একটি চার্জ লাইট জ্বালিয়ে বসে আছেন। এদিকে রাত যত গভীর হচ্ছে বৃষ্টির মাত্রাও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। কাস্টমার আসার সম্ভাবনা ক্ষীণ হতে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় খাবারগুলো ফ্রিজিং করাও সম্ভব নয়। ভাবছেন, ব্যবসা তো গেলই সঙ্গে এতগুলো খাবারও নষ্ট হলো।
আচমকা অনুভব করলেন, পেছন দিক থেকে কেউ দোকানে প্রবেশের চেষ্টা করছে। আলো-আঁধারিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। মৃদু ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, কে ওখানে? ভাঙা স্বরে নারী কণ্ঠ ভেসে এলো, আমাদের একটু খাবার দিতে পারবেন? উনি বাতি নিয়ে একটু সামনে এগিয়ে গেলেন। দেখলেন, জীর্ণবসনা এক নারী দুটি বাচ্চাকে আগলে রেখেছেন। মহিলা নিজ থেকেই বললেন-তার স্বামী কিছুদিন আগে মারা গেছেন। ঘরে খাবারের মতো কিছু নেই। বাচ্চারা ক্ষুধার তাড়না সহ্য করতে পারছে না। সবকিছু শুনে রেস্টুরেন্ট মালিকের মনে দয়া হলো। খাবার তো প্রস্তুত ছিলই। সেখান থেকে কিছুটা তাদের খেতে দিলেন। তারা তৃপ্তিসহকারে আহার করল। যাওয়ার সময় মনভরে দোয়া করল। অস্ফুট স্বরে বলল, বর্ষণমুখর এই রাতে আপনি আমাদের আশ্রয় দিয়েছেন। অনাহারি বাচ্চাদের জন্য রিজিকের ব্যবস্থা করেছেন। এ রাতকে আল্লাহ আপনার জন্য বরকতময় করে দিন। রেস্টুরেন্ট মালিক ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বললেন, রাত তো ঝড় বৃষ্টিতেই কেটে যাচ্ছে। এত রাতে কেউ আসবেও না। তবু আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হওয়া যাবে না। দেখা যাক কী হয়?
ধীরে ধীরে বৃষ্টির তীব্রতা কমতে শুরু করেছে। সহসা একটি বাস আঙিনায় এসে থামল। বাস ভর্তি যাত্রী। ঝড় বৃষ্টির কারণে তারা গন্তব্যে যেতে পারেনি। তাই এখানেই খাবার গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। রেস্টুরেন্ট মালিকের মুখে হাসি ফুটে উঠল। হোটেল পরিচারকদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত খাবার পরিবেশন করলেন। নতুন করে আরও খাবার রান্না করা হলো। তাও শেষ হলো। তৃপ্তির আবেশে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ!! মাওলার লীলা বোঝা বড় দায়। তিনি বৃষ্টির ঝাপটা দিয়ে ক্ষুধার্ত বাচ্চাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। তোফানের সংকেত দিয়ে বাসভর্তি যাত্রীদের পাঠিয়ে দিলেন রেস্টুরেন্টে। লোকসানের শঙ্কায় শঙ্কিত ব্যবসায়ীকে তৃপ্ত করলেন মুনাফা দিয়ে। রাসূল (সা.) যথার্থ বলেছেন, সদকা খায়রাতের দ্বারা সম্পদ কমে না বরং বাড়ে। তাই যেন আজ বাস্তবায়িত হলো।
সদকা এমন একটি ইবাদত যার ফলাফল ইহজগতেও দৃশ্যমান। সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিমোচন হোক কিংবা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সর্বক্ষেত্রে সদকা হলো দারুণ কার্যকরী। পারস্পরিক হৃদ্যতার কথা উঠুক অথবা আত্মিক তৃপ্তি লাভের আলোচনা, কোনো ক্ষেত্রেই সদকার নেই কোনো তুলনা। সদকার দুটি দিক রয়েছে। প্রথমটি ফরজ, যা আমরা জাকাত বলে জানি। দ্বিতীয়টি নফল, আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য মানুষের উপকারার্থে যা কিছু ব্যয় করা হয় সবই এর অন্তর্ভুক্ত। ইসলামে বেশি বেশি দান সদকা করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। কুরআন হাদিসে অসংখ্যবার দানের ফজিলতের কথা বর্ণিত হয়েছে। হজরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন নিশ্চয়ই সদকার মাধ্যমে আল্লাহর অসন্তুষ্টি দূরীভূত হয় এবং অপমৃত্য থেকে বাঁচিয়ে রাখে।
বস্তুবাদী ধ্যানধারণায় লালিত সমাজের লোকজন মনে করে দান সদকার মাধ্যমে সম্পদ ফুরিয়ে যাবে। অথচ হাদিসে কুদসিতে রাসূল (সা.) বলেন, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, হে বনি আদম তোমরা অন্যের জন্য সম্পদ ব্যয় কর। আমি তোমাদের জন্য সম্পদের ব্যবস্থা করে দেব। তিনি আরও বলেন, সদকা খায়রাত বিপদ আপদ থেকে মুক্তি দেয়। তা ছাড়া পরকালে জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাকা বা জান্নাতে উঁচু মর্যাদা লাভ করার জন্যও সদকার হাত প্রসারিত করা অপরিহার্য। রাসূল (সা.) বলেন, তোমরা এক টুকরা খেজুর সদকা করে হলেও জাহান্নাম থেকে বেঁচে থাক। অন্যত্র বলেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি সদকা খায়রাত করবে তাকে কিয়ামতের দিন বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে আহ্বান জানানো হবে।