২০১৩ সালের ৫ মে তাণ্ডবের পর ঢাকাসহ সাতটি জেলায় ৮৩টি মামলা হয় হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে। ওইসব মামলায় ৩ হাজার ৪১৬ জনের নামসহ ৮৪ হাজার ৯৭৬ জনকে আসামি করা হয়। তার মধ্যে বাগেরহাটের একটি মামলার বিচার শেষ হলেও রায়ে সব আসামি খালাস পেয়ে যান। দুটি মামলার অভিযোগ প্রমাণ করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। আর ১৮টি মামলার অভিযোগপত্র দিলেও এর বিচার প্রক্রিয়া শুরুই হয়নি। চলতি বছরের মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরকে কেন্দ্র করে হেফাজত ইসলাম আচমকা বিরোধিতা শুরু করে। ২৫ ও ২৬ মার্চ সংগঠনটি বিক্ষোভ মিছিলের নামে ঢাকা, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের কয়েকটি স্থানে ব্যাপক তা-ব চালায়। বিশেষ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি অফিস-আদালত, ভূমি অফিস, এসপির অফিসসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে ধ্বংসষজ্ঞ চালায়। ওইসব স্থান পুলিশের মহাপরিদর্শকসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার কর্তাব্যক্তিরা পরিদর্শন করেন। ঘটনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশপ্রধানের ঘোষণার পর থেকেই হেফাজত ইসলামের বিরুদ্ধে তদন্তে নামে পুলিশ-র্যাবসহ আইনপ্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। হেফাজতের একাধিক আয়-ব্যয়ের হিসাবে ঘাপলা শীর্ষ নেতার ব্যাংক হিসাবও তলব করা হয়। মামুনুলসহ অন্তত ১৭ জন শীর্ষ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। হেফাজতের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদরাসাগুলোর পুলিশের ডিবি, সিআইডি, পিবিআইসহ একাধিক সংস্থা তদন্ত করছে।
প্রাথমিক হিসাব-নিকাশে কোন কোন মাদরাসায় হিসাবে গরমিল পেয়েছে তার তালিকা হচ্ছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন। তিনি জানান, তালিকাটি আগামী মাসে চূড়ান্ত করা হবে। প্রাথমিক একটি তালিকা করা হয়েছে। ওই তালিকায় অন্তত দেড়শ মাদরাসার নাম উঠে এসেছে। বেশিরভাগ মাদরাসার সঙ্গেই হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের নাম এসেছে। নেতাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনেও আলাদাভাবে তদন্ত করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, নেতাদের কেউ কেউ দেশের বাইরেও অর্থ পাচার করেছে বলে তথ্য মিলছে। তাছাড়া যাদের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে তাদের অ্যাকাউন্টে লেনদেনে গরমিল পাওয়া গেছে। রিমান্ডে যেসব আসামি আছেন তারাও মাদরাসাগুলোতে অর্থ গরমিলের বিষয়টি স্বীকার করেছেন বলে দাবি করেছে পুলিশ।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল বলেন, হেফাজতে ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদরাসাগুলো কীভাবে চলে তারা সরকারকে কিছু জানায় না। আমরা চাচ্ছি একটি নিয়মের মধ্যে থেকে মাদরাসাগুলো পরিচালিত হোক। এ ক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের হিসাবটিও স্বচ্ছতা থাকাটা জরুরি। হিসাবে কোনো ধরনের গরমিল পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর নিয়ে হেফাজত যা করেছে তা কিছুতেই সহ্য করার মতো না। তারা অফিস-আদালতসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোয় ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলছে। এ ক্ষেত্রে হেফাজত নেতাদের বিরুদ্ধে আগ বাড়িয়ে কিছুই করা হচ্ছে না। যারা তা-বের সঙ্গে জড়িত তাদেরই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। একই কথা বলেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ। তিনি বলেন, তা-বের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবেই। ব্রাহ্মণবাড়িয়াতেই হেফাজতের অসংখ্য মাদরাসা। তাছাড়া অন্য জেলাগুলোতেও তাদের মাদরাসা আছে। ওইসব মাদরাসা কীভাবে চলে তার কোনো হিসাব আছে কি না সন্দেহ রয়েছে। কাদের অনুদানে মাদরাসাগুলো চলছে তাও খুঁজে বের করা উচিত। আমরা চাচ্ছি নিয়মের মধ্যে থেকে মাদরাসাগুলো পরিচালিত হোক।
২০১৩ সালের শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবিতে হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, ওই ঘটনার পর যদি হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে তারা আর মাথা গজিয়ে ওঠার সাহস পেত না। গত ২৫ ও ২৬ মার্চ হেফাজত যেভাবে তা-ব চালিয়েছে তা ভয়ংকর। তা-বের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরে দফায় দফায় বৈঠক করা হয়। হেফাজত নেতাদের পুরো আমলনামা তৈরি করা হয়। পাশাপাশি মাদরাসাগুলোর আয়-ব্যয়ের হিসাব বের করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনা পেয়ে পুলিশের বিভিন্ন সংস্থাগুলো তদন্তে নেমে পড়ে।
পুলিশ সূত্র জানায়, তদন্তে যেসব মাদরাসায় হিসাবে ঘাপলা আছে তার মধ্যে হাটহাজারী মঈনুল ইসলাম মাদরাসা, ইছাপুর ফয়েজিয়া মাদরাসা, মেখল মুফতি ফয়েজুল্লাহ মাদরাসা, চারিয়া কাসেমুউলুম মাদরাসা, ফতেপুর মাদরাসা, ঢাকার জামিয়া ইসলামিয়া মাদানিয়া মাদরাসা, তামিরুল মিল্লাত আলিয়া মাদরাসা, রায়তুন নুর মাদরাসা, সানারপাড়ের নিমাই কাশারীর জামিয়াতুল আবরার হাফিজিয়া মাদরাসা, সিদ্ধিরগঞ্জের মাদানীনগরের মাদরাসা, হাদুশ শাইখ ইদরীম আর ইসলাম আল-জামিয়াতুল ইসলামিয়া দারুল উলুম মাদরাসা, সানারপাড়ের আশরাফিয়া মহিলা মাদরাসা, আব্দুল আলী দারুস সালাম হিফজুল কোরআন মাদরাসা, ইফয়জুল উলুম মুহডিচ্ছুন্নাহ আরাবিয়্যাহ মাদরাসা, নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের আল জামিয়াতুল ইসলামিয়া নূরুল কোরআন মাদরাসা, ভূঁইয়াপাড়া জামিয়া মুহাম্মদীয়া মাদ্রাসা, মারকাজুল তাহরিকে খতমি নবুওয়াত কারামাতিয়া মাতালাউল উলুম মাদ্রাসা, নূরে মদিনা দাখিল মাদ্রাসা ও জামিয়াতুল ইব্রাহীম মাদ্রাসা, হাটহাজারীর জামিয়া আহদিয়া দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা, হাটহাজারীর জামিয়া ইসলামিয়া হামিউস সুন্নাহ মাদ্রাসা, চারিয়া হাটহাজারীর জামিয়া ইসলামিয়া ক্বাসেমুল উলুম মাদ্রাসা, ফতেহপুর হাটহাজারীর জামিয়া হামিদিয়া নাছেরুল ইসলাম মাদ্রাসা, মাহমুদিয়া মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসা, ফটিকছড়ির বাবুনগর আজিজুল উলুম মাদ্রাসা, আল-জামিয়াতুল কোরআনিয়া তালিমুদ্দিন হেফজখানা ও এতিমখানা, নাজিরহাট আল জামেয়াতুল আরাবিয়া নাসিরুল ইসলাম মাদ্রাসা, জাফতনগর হাফেজুল উলুম মাদ্রাসা ও এতিমখানা, উত্তর নিশ্চিন্তপুরের তালীমুল কোরআন বালক-বালিকা মাদ্রাসা ও এতিমখানা, চট্টগ্রামের পটিয়ার আল-জামিয়া আল-ইসলামিয়া মাদ্রাসা, হাফেজিয়া তালীমুল কোরআন মাদ্রাসা ও এতিমখানা এবং আশিয়া এমদাদুল উলুম মাদ্রাসা হেফজখানা ও এতিমখানা, চট্টগ্রামের ভুজপুরের উত্তর বারমাসিয়া হাফেজুল উলুম ইসলামিয়া মাদ্রাসা, দাঁতমারা তালিমুল কোরআন ইসলামিয়া মাদ্রাসা, আল জামিয়া ইসলামিয়া এমদাদুল ইসলাম মাদ্রাসা, আল মাহমুদ ইসলামিয়া বালক-বালিকা মাদ্রাসা, আল মাদ্রাসাতুল ইসলামিয়া আল আরাবিয়া হেফজখানা, এতিমখানা বালক-বালিকা মাদ্রাসা এবং চট্টগ্রামের বেতুয়ার সিরাজুল উলুম মাদ্রাসা, মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া মাদ্রাসা, আল-হাইয়্যাতুল উলয়াও বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আরকাম মাদ্রাসা, জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা, ইসলামপুর মাদ্রাসা, সৈয়দুন্নেসা মাদ্রাসা, অষ্টগ্রাম বাজার মাদ্রাসা, আশুগঞ্জ বেড়তলা মাদ্রাসা, সরাইল উচালিয়া মাদ্রাসা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া দারমা মাদ্রাসা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাটাই দক্ষিণ বিরাসার মাদ্রাসা, জামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসা ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে সিআইডির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, এসব মাদরাসার পাশাপাশি ঢাকার মোহাম্মদপুর, লালবাগ, যাত্রাবাড়ী, বারিধারায় বিভিন্ন মাদরাসার নানা অনিয়ম তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব মাদরাসার অধিকাংশের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। দেশের বাইরে থেকে আসা অনুদান কীভাবে খরচ করা হয় তার কোনো নথিও সংরক্ষণ করা হয় না বেশিরভাগ মাদরাসায়ই। আবার কোনো কোনো মাদরাসার বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানির লাইন অবৈধ আছে। এগুলোও আমরা তদন্ত করছি। তিনি আরও বলেন, আয়-ব্যয়ের হিসাব ঘাপলা থাকায় বাবুনগরী, মুহাম্মদ মাহফুজুল হক, মাহমুদুল হাসান, মুফতি মুরি হোসাইন কাসেমী, মাওলানা মো. বোরহান উদ্দিন কাশেমী, মাওলানা হাফেজ ইদ্রিস, মাওলানা মামুনুল হক, মাওলানা বোরহান উদ্দিনসহ অন্তত শতাধিক নেতা ফেঁসে যেতে পারেন। তাদের বিষয়ে দুদকও তদন্ত করার কথা রয়েছে বলে আমরা জানি। যারা মাদরাসাগুলোতে অর্থ দিয়েছেন তাদের তদন্তের আওতায় আনা হবে।
ডিএমপির তেজগাঁও ডিভিশনের উপপুলিশ কমিশনার হারুন অর রশীদ জানান, হেফাজতের নিয়ন্ত্রণাধীন মাদরাসাগুলোতে কোনো নিয়মনীতির বালাই নেই। তারা ইচ্ছেমতো মাদরাসাপরিচালনা করে। এজন্য আমরা ওইসব মাদরাসার আয়-ব্যয়ের হিসাবটিও খতিয়ে দেখছি। তাছাড়া হেফাজত নেতা মামুনুলও তার মাদরাসার হিসাব নিয়ে এলোমেলো কথা বলেছেন। তার দেওয়া তথ্যগুলো আমরা খতিয়ে দেখছি।