পরিচালনা করছেন নতুন এমএলএম কোম্পানি
কারাগারে বসে জুমে মিটিং করেন ডেসটিনির রফিকুল
অফিসও নয়, নিজের বাড়িও নয়। কিন্তু কয়েক বছর ধরে কারাবন্দি। অথচ সবকিছুই চলছে তার স্বাভাবিক নিয়মে। কারাগারে বসেই ব্যবসা পরিচালনা করছেন, নিয়মিত মিটিংও চলছে সতীর্থদের সঙ্গে! আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন বহুল আলোচিত ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ রফিকুল আমীন। একবার কিংবা দুবার নয়, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই জুম অ্যাপের মাধ্যমে তিনি ব্যবসায়িক মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন। দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন ব্যবসায়িক সহকর্মীদের। এমনকি নেপথ্যে থেকে খুলেছেন নতুন মাল্টি লেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। আরও কয়েক ধরনের প্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়েও নাকি চলছে আলোচনা। অথচ এমএলএম কোম্পানি দিয়েই তিনি দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। আমাদের সময়ের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে কারাগার থেকেই রফিকুল আমীনের নতুন কোম্পানি খুলে নেপথ্যে পরিচালনা এবং জুম মিটিংয়ের আদ্যোপান্ত।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলায় ডেসটিনির এমডি মোহাম্মদ রফিকুল আমীন ২০১২ সালে গ্রেপ্তার হন। এর পর থেকে বেশিরভাগ সময় নানা অসুস্থতার বাহানায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ^বিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) প্রিজন সেলেই থাকেন। বর্তমানেও বিএসএমএমইউ প্রিজন সেলে তিনি চিকিৎসসাধীন। কিন্তু স্পর্শকাতর এমন জায়গায় থেকেও অনলাইনে সংযোগ এবং নিয়মিত বিভিন্ন মিটিংয়ে অংশ নিচ্ছেন এ আসামি। এ সংক্রান্ত ছয়টি জুম মিটিংয়ের রেকর্ড দৈনিক আমাদের সময়ের হাতে এসেছে। এর মধ্যে একটি জুম মিটিংয়ের রেকর্ড ঘেঁটে জানা যায়, আদালতের রায় অমান্য করে অস্তিত্বহীন কোম্পানির শেয়ার বিক্রি ও বিদেশ থেকে টাকা আনার পরিকল্পনা করেছেন রফিকুল আমীন।
এমনকি দেশ ও বিদেশে অবস্থানরত ডেসটিনির সদস্যদের সঙ্গেও রয়েছে তার নিয়মিত যোগাযোগ। নতুন প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের আশ্বাস দিয়ে তিনি জানান, বিদেশ থেকে আটশ কোটি টাকা আনা হবে। সেই সঙ্গে ওই এমএলএম ব্যবসায় জুলাই-আগস্ট থেকে এক হাজার থেকে ১২০০ জনবল নিয়োগ দেওয়ার কথাও জানান। পরে তিনি কী ধরনের ব্যবসা করবেন, কীভাবে মার্কেটিং করবেন সে সংক্রান্ত বিষয়েও আলোচনা করেন জুম মিটিংয়ে।
একটি সূত্রে জানা যায়, প্রায় প্রতি সপ্তাহেই রফিকুল আমীন জুম মিটিংয়ের আয়োজন করেন। এসব মিটিংয়ে অংশ নেন তার প্রতিষ্ঠিত নতুন কোম্পানির শেয়ারহোল্ডাররা। এতে নতুন নতুন ব্যবসায়িক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের কৌশল নিয়েও আলোচনা হয়। মোটিভেট করেন শেয়ারহোল্ডারদের। এ ছাড়া একটি মিটিংয়ে সারাদেশের উপজেলা পর্যায়ের শেয়ারহোল্ডারদের নিয়েও মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়।
তৈরি করতে যাওয়া অস্তিত্বহীন এমএলএম কোম্পানির শেয়ার বিক্রির কথাও বলেন অন্য একটি জুম মিটিংয়ে। এতে বলা হয়, যদি কেউ তার কোম্পানির একশ টাকার শেয়ার কিনে তবে একবছর পর লভ্যাংশ পাবেন ১ হাজার ৮০০ টাকা। আর ৫ হাজার টাকার কিনলে পাবেন ৯ হাজার টাকা। কেউ যদি ৫ লাখ টাকার শেয়ার কিনেন তবে পাবেন ৯ লাখ টাকা।
বিভিন্ন জুম মিটিংয়ে রফিকুল আমিন ব্যবসায়িক পরিকল্পনায় দেখা যায়, ডিটুকে অ্যাসোসিয়েট লি. একটি প্রাইভেট কোম্পানি। এ কোম্পানির ডান সাইটে সুপিরিয়র মার্কেটিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিেিটডের ৪০০ সেন্টার রয়েছে। এ সেন্টারের নিচে ৭টি সংগঠনের প্রত্যেকের ৩১টি করে সেন্টার রয়েছে। ৭টি সংগঠনের ৩১টি সেন্টারের নিচে আবার ১৬৫টি কোম্পানির প্রত্যেকের আবার ৩১টি করে সেন্টার রয়েছে। এভাবে সব কোম্পানির শেয়ারহোল্ডারদের সেন্টারের নিচে ব্যক্তিগত ডিনধারী ব্যক্তিদের সেন্টার রয়েছেল বর্তমানে ২৭০০ ডিনধারী ব্যক্তি কাজ করলেই ১৬৫টি কোম্পানি ৩১টি সেন্টার, ৭টি সংগঠনের ৩১টি সেন্টার এবং সুপিরিয়র মার্কেটিংয়ের ৪০০ সেন্টার প্রতিদিন অটোতে সাইকেল কম্পিলিড হবে এবং এ ১৬৫টি কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার যারা আছেন তারা তাদের নিজস্ব সেন্টার বাদেও ৮ থেকে ১০টি জায়গা থেকে অ্যাকাউন্টে টাকা পাবেন।
আরও জানা যায়, যে কোনো ডিনধারী ব্যক্তি, কোম্পানি কিংবা ৭টি সংগঠনের সবাই কোম্পানির শেয়ারহোল্ডার হতে পারবে। এভাবে আগামী ডিসেম্বর ২০২১-এর মধ্যে ১ লাখ ব্যক্তি এই সুপিরিয়র মার্কেটিং অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের শেয়ারহোল্ডার হতে পারবেন।
আকাশচুম্বী লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, এ সুপার মার্কেটিং সেন্টার থেকে প্রতিমাসে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা যা বছরে ২১ কোটি ৬০ লাখ টাকা লভ্যাংশ আসবে। সব শেয়ারহোল্ডার এ লভ্যাংশ পাবেন।
শুধু তাই নয় নতুন বিজনেসে প্রতিটি উপজেলা পর্যন্ত নেটওয়ার্কে স্থাপনের কথাও বলেন তিনি। এতে বলা হয় প্রতিটি উপজেলায় দুজন করে কর্মকর্তা থাকবেন। তারা কোম্পানির প্রোডাক্ট বিক্রি করবেন। নতুন ক্রেতা তৈরি করবেন। বিক্রি হওয়া আয় থেকে তারা লভ্যাংশ পাবেন। এ ছাড়া ডায়াবেটিসের জন্য বিশেষ ওষুধ বিক্রির কথাও এতে বলা হয়।
রফিকুল আমিনের জুম অ্যাপসের মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন বোরহানউদ্দিন বোরহান নামের একজন শেয়ারহোল্ডার। মিটিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, রফিকুল আমিন সাহেব ডিটুকে অ্যাসোসিয়েটস নামের নতুন একটি কোম্পানির সৃষ্টি করেছেন। উনি জেলখানায় যাওয়ার পর কোম্পানিটি তৈরি করেছেন। যেখানে ১৬৫টি কোম্পানি রয়েছে। যেগুলো রেজিস্ট্রেশন করা। উনি ডেসটিনির নাম বলে মূলত টাকাটা নিয়েছিলেন। সেটা হলো ক্রুশিয়ার হিসেবে। যেটি বোর্ডের অনুমতি ছিল না। পরে তিনি নতুন কোম্পানি করেন। ডিটুকে অ্যাসোসিয়েটস ছাড়াও সুপারওয়ে, স্বপ্নের শহরসহ আরও অনেকগুলো কোম্পানি করেছে। আমাদের থেকে টাকা-পয়সা নিয়েছেন।
উনি জেলখানা থেকেই আমাদের মোটিভেট করছেন। নেতৃত্ব দেবেন। পাশাপাশি প্রতিদিনই বলে বের হয়ে যাবেন। উনার সাথে আমি গত রোজার মধ্যে দুটি মিটিংয়ে অংশ নিয়েছি।
রোকন নামের অংশগ্রহণকারী একজন আমাদের সময়কে বলেন, আমি তো কর্ণধার নয়। বিষয়টি জানতে ঊর্ধ্বতনদের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
মিটিংয়ে অংশ নিয়েছেন মাসুদ নামের একজন শেয়ারহোল্ডার। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, ডিটুকে অ্যাসোসিয়েটস নামের একটি অনলাইন মার্কেটিং প্লেসের বিষয়ে কথা হয়েছে। এমএলমও রয়েছে সঙ্গে। এটি নিয়েই রফিকুল আমিন সাহেব কথা বলেছেন। মিটিংয়ে ঢোকার কিছুক্ষণ পরই লাইন কেটে যাওয়ায় আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। পরে চেষ্টা করেও আর ঢুকতে পারিনি।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মীর আহমেদ আলী সালাম বলেন, তিনি জেলে আছেন। কোনোভাবেই জেল থেকে ব্যবসায়িক আলোচনা করতে পারবেন না। জুম মিটিংয়েও অংশ নিতে পারবেন না। এমন কাজ করলে জেল বিধি ও কোর্টের রায় লঙ্ঘন হয়েছে।
এ বিষয়ে সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ আমাদের সময়কে বলেন, এমনটি হওয়ার কথা নয়। তিনি প্রিজন সেলে আছেন। সেখানে পুলিশ আছে, হাসপাতালের লোকজন আছে। আমাদের কারারক্ষীরা রয়েছেন। সেখানে কীভাবে জুম মিটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। করতে পারার কথা নয়। তবে ঘটনা সত্যি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করব।