শনিবার | সেপ্টেম্বর ১১,
এসআই শফিক
আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী-চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসীদের আর নৌকায় উঠাবে না সরকারি দল আওয়ামী লীগ। একইসাথে স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও যারা দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী ছিলেন এবং যারা সামনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন ভবিষ্যতে তাদেরও দলীয় মনোনয়ন না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। তবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে দলকে তৃণমূল পর্যায় থেকে সুসংগঠিত করে নৌকার জয়ের ধারা অব্যাহত রাখতে চায় দলটি। এ লক্ষে জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বিভিন্ন ইউনিটের গতি বাড়াতে সাংগঠনিক কর্মকান্ড আরও জোরদার করতে মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটিগুলোকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা করছে দলটি। গত বৃহস্পতিবার দলের সর্বশেষ নির্বাহী সংসদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্তই হয়েছে বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
বৈঠকে আগামী জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পাশাপাশি দ্রুত সময়ে তৃণমূল পর্যায়ের সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সাংগঠনিক ভিত্তি আরও সুসংহত করার নির্দেশ দেন দলীয়প্রধান শেখ হাসিনা। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন দলের এমন কয়েকজন নেতার সাখে কথা বলে জানা গেছে, বহুদিন পর দলীয় প্রধানের সাথে নেতাদের নিয়ে সম্মুখ সাক্ষাতে বৈঠক হয়েছে। এটি আমাদের কার্যনির্বাহী সংসদের সব সদস্যের জন্যই একটা আনন্দের দিন ছিল। আমাদের সাংগঠনিক আলাপ-আলোচনা হয়েছে। কিছু জায়গায় সংগঠনের অভ্যন্তরীণ তথা কোথাও নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা দূরত্ব তৈরি হয়ে আছে; সেই বিষয়গুলো চিহ্নিত করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন নেত্রী। ভবিষ্যতে সেগুলো যেন আর না হয় এবং তা দ্রুত সময়ে নিরসনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগীয় নেতাদের তাগিদ দিয়েছেন তিনি। চিহ্নিত দূরত্ব তথা সংকটগুলো দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিরসনের জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রভাব বলয় তৈরির বিষয়ে দলীয় প্রধানের নির্দেশনার বিষয়ে নেতারা জানান, সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। তাই যারা দলের ভেতরে উপদল বা দলের মধ্যে ঘর তৈরি কিংবা দলের যেসব সংসদ সদস্যের মধ্যে নিজেদের বলয় তৈরির প্রবণতা রয়েছে, তাদেরও এ ধরনের প্রবণতা থেকে বিরত থাকার আহবান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা। তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, দল থাকলেই এমপি থাকবে, দল থাকলেই রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকব। সুতরাং দলের কাঠামো যদি দুর্বল হয়ে পড়ে, ভেঙে পড়ে, তাহলে নিজস্ব ব্যক্তিগত শক্তি দিয়ে আমাদের যে অশুভ শক্তিকে মোকাবিলা করতে হবে; সেটি তো কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। তাই তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার বার্তা দিয়েছেন। যেসব সংসদ সদস্য জেলা পর্যায়ে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন, তাদের আগামী দিনে সাংগঠনিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ইঙ্গিত বা নির্দেশনা এসেছে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে নেতারা জানান, এমপিদের তো কতগুলো বাড়তি সুযোগ-সুবিধা থাকে, যেগুলো সহজেই নেতাকর্মীদের প্রভাবিত করার সুযোগ তৈরি করতে পারে। সেটি যেন দলের পক্ষে থাকে, কোনো ব্যক্তিবাদ যেন গড়ে না ওঠে, সে বিষয়ে নজর দেওয়া হবে। নেতারা বলেন, আট বিভাগের সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের প্রতিবেদন উপস্থাপন করার পাশাপাশি তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন সংকট-দ্বন্দ্ব-প্রভাব বিস্তার করার দিক তুলে ধরেছেন। এতে কোথায় পারস্পরিক ভুল বোঝাবুঝি আছে, কারা কোথায় একে-অন্যের বিরুদ্ধে কথাবার্তা বলে, আবার কিছু কিছু জায়গায় দল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে— সেই বিষয়গুলোও আলোচনায় এসেছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে যেসব জেলা সম্মেলন করার অপেক্ষায় আছে বা যেসব জেলায় সম্মেলন জরুরি, সেসব জেলায় সম্মেলন আয়োজনের তাগিদ দেওয়া হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ তো বটেই, অনেক জায়গায় অনেক ক্ষেত্রে অনেক কারণেই সংগঠনের ভেতরে স্থবিরতা বা সমন্বয়হীনতা প্রকট। সেগুলো নতুনভাবে ঢেলে সাজানোর একটা তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগ কাজ করতে যাচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, বছরের পর বছর সংগঠনের এসব ইউনিটে নতুন নেতৃত্ব না আসায় যেমন ভেঙে পড়েছে চেইন ইন কমান্ড, তেমনি সৃষ্টি হয়েছে অভ্যন্তরীণ বিভেদ। নেতা-কর্মীরা নিজেদের মধ্যে জড়াচ্ছেন সংঘর্ষে, চলছে দল থেকে অব্যাহতি, অব্যাহতি খেলা। পরিস্থিতির দিকে নজর রেখে এবার সংগঠন গুছিয়ে শৃঙ্খলা আনতে উদ্যোগ নিয়েছে আওয়ামী লীগ। আড়াই বছর আগে দলের ২১তম কাউন্সিলের পর মেয়াদোত্তীর্ণ এসব কমিটি ভেঙে দিয়ে সংগঠন গোছাতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেয় আওয়ামী লীগ। তবে করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে ধাক্কা লাগে সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাসের সেই কাজে। দেশে করোনা সংক্রমণের কারণে সাংগঠনিক কর্মকান্ড স্থগিত করে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। গত বছরের মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত এই কর্মকান্ড অব্যাহত রয়েছে। গত আগস্টে করোনার বিস্তার কিছুটা কমে এলে সাংগঠনিক কর্মকান্ড শুরু করলেও এগোতে পারেনি। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্থবির হয়ে পড়ে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ড। তবে করোনার প্রাদুর্ভাবের দীর্ঘমেয়াদী অবস্থানের কারণে ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সাংগঠনিক কর্মকান্ড শুরু করছে আওয়ামী লীগ। এজন্য অনলাইন প্লাটফর্মকেও কাজে লাগিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, নির্বাচনে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়া মানে নেত্রীর সিদ্ধান্ত অগ্রাহ্য করা। যারা নেত্রীর সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রার্থী হবেন, তারা কখনও দলের সদস্যপদ পাবে না এবং আওয়ামী লীগের নৌকায় উঠতে পারবে না। তিনি বলেন, দলে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকতে পারে; যারা আওয়ামী লীগ করবে তাদের সবাইকে নেত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে নৌকার পক্ষে কাজ করতে হবে। কোনো বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নৌকায় আর চড়তে পারবে না। যারা বিদ্রোহ করবে তারা দলের সদস্যপদ পাবে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমÐলীর সদস্য আব্দুর রহমান বলেন, নির্বাচন তো অবশ্যই একটি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ আমাদের সামনে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্যেই আমাদের জনগণের আস্থা অর্জন করে ক্ষমতায় ফিরতে হবে। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের অগ্রসর হতে হবে। সেই নির্দেশনাই দলীয় সভানেত্রী আমাদের দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে সংগঠনের বিরুদ্ধে, সংগঠনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যদি জাতীয় নির্বাচনে কেউ অবস্থান গ্রহণ করে বা বিদ্রোহী হয়, তাদের ব্যাপারে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণেরও একটা ইঙ্গিত তিনি (শেখ হাসিনা) দিয়েছেন। প্রয়োজনে তাদেরকে বহিষ্কার করা হবে। আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান বলেন, আমাদের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে যে তাদের (বিদ্রোহী) আর নমিনেশন দেওয়া হবে না। তাদের ব্যাপারে আরও বেশি কঠোর থাকা হবে। আগামী নির্বাচনই হোক, স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক আর যেকোনো জাতীয় নির্বাচনই হোক— সব নির্বাচনেই এই নীতি অব্যাহত থাকবে। কেবল জাতীয় নির্বাচন নয়, যারা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে একবার দলের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছে, তাদের অনেকের নাম এলেও আমরা কিন্তু মনোনয়ন দিচ্ছি না। এই ধারা অব্যাহত থাকবে।