ড. মুহাম্মদ শফিউর রহমান
ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি, যাদের শরীরে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা যত বেশি, তাদের কোভিড-১৯-এ মৃত্যুর আশঙ্কা তত কম। এ মুহূর্তে আপনি ঘরে থেকে কীভাবে আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারেন, সে বিষয়ে একটু ধারণা নেওয়া যাক।
প্রথমেই বলি, আপনাকে সুষম খাদ্য খেতে হবে, মানে মোট খাবারের ৫০-৬০ শতাংশ কার্বোহাইড্রেট (ভাত, আলু, রুটি ইত্যাদি), ২০-২৫ শতাংশ আমিষ (প্রধানত মাছ, মাংস, ডাল, দুধ, ডিম ইত্যাদি। এর সঙ্গে পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি) এবং ১৫-২০ শতাংশ চর্বিজাতীয় খাদ্য (রান্নায় ব্যবহৃত তেলসহ যে কোনো খাবার তেল/চর্বি, ডিমের কুসুম, মাছের তেল, পনির, মাখন ইত্যাদি, খুব ভালো হয় যদি কালোজিরা, পেরিল্লা, তিসি ও জলপাইয়ের তেল খাওয়া যায়)।
সন্ধ্যা ৭-৮টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করুন। এ সময় ম্যাক্রো-পুষ্টি (কার্বোহাইড্রেট, আমিষ ও চর্বি) একটু কম খেয়ে অনু-পুষ্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে হবে। কিটোডায়েট পরিহার করুন, তা না-হলে আপনার মস্তিষ্ক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে মনোযোগ না-দিয়ে কার্বোহাইড্রেট খুঁজে বেড়াবে, তার নিউরন কোষগুলো সতেজ রাখার জন্য, যা এ মুহূর্তে ঠিক নয়।
এখন অনু-পুষ্টি নিয়ে আলোচনা করা যাক। মূলত বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ খাদ্যই হচ্ছে অনু-পুষ্টি। এগুলোর প্রধান উৎস হচ্ছে তাজা শাকসবজি ও ফলমূল। দামি বিদেশি ফল খেতে হবে এমন নয়, আমাদের দেশীয় ফল যেমন: আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, লিচু, পেয়ারা, জাম্বুরা, আমড়া, আমলকী, জলপাই ইত্যাদি খুব বেশি করে খাওয়া যেতে পারে। লেবুর ওপর চাপ কমিয়ে অন্যান্য টকজাতীয় ফল খান।
বাসায় কোয়ারেন্টিনে থাকার কারণে আপনার শরীরে সূর্যের তাপ লাগছে না, সেজন্য ভিটামিন ডি উৎপন্ন ব্যাহত হচ্ছে। তাই ভিটামিন ডি-যুক্ত খাদ্য যেমন: সামুদ্রিক মাছ বা মাছের তেল, ডিমের কুসুম, কলিজা, দই ইত্যাদি খেতে হবে। পাশাপাশি চেষ্টা করুন বাসার ছাদে বা বাড়ির উঠানে গিয়ে শরীরে ২০-৩০ মিনিট রোদ লাগাতে। এ ছাড়া আপনার দৈনিক খাদ্যতালিকায় যেন অবশ্যই ভিটামিন বি-৩, জিঙ্ক, আয়রন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্টসমৃদ্ধ খাদ্য থাকে।
এখন আসুন জেনে নিই এগুলো কোথায় পাওয়া যাবে এবং শরীরে এগুলো কী কাজ করে। ভিটামিন বি-৩ (অন্য নাম নিয়াসিন বা নিকোটিনামাইড) থাকে মাছ, মাংস, বাদামি চাল, মাশরুম ও শাকসবজিসহ বিভিন্ন বীজজাতীয় খাবারে যেমন: শিমের বীজ, মটরশুঁটি, বাদাম, এভোকেডো ইত্যাদিতে। ভিটামিন বি-৩ আপনার ফুসফুসের কোষগুলোকে বিভিন্ন ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করবে। ফলে আপনার ভেন্টিলেশন বা শ্বাস-প্রশ্বাসের উন্নতি হবে।
কিছু কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, ভিটামিন বি-৩ ফুসফুসের সুরক্ষায় খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এর ট্যাবলেট খেলে এটি ১৬ মিলিগ্রাম করে প্রতিদিন খেতে পারেন। তবে তা দৈনন্দিন খাদ্য থেকে সংগ্রহ করাই ভালো।
এবার আসুন জিঙ্ক সম্পর্কে জানি। এ মুহূর্তে এটি অত্যন্ত কার্যকর একটি খনিজ, যা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় সামুদ্রিক প্রাণী, বিশেষ করে শামুকে। এ ছাড়া মাংস, সয়াফুড, কালো তিসি, সিমের বীজ, মিষ্টিকুমড়ার বীজ, আলমন্ড, মসুর ডাল ইত্যাদিতেও পাওয়া যায়। কোভিড-১৯ আরএনএ পলিমারেজ এনজাইম (আরডিআরপি) দ্বারা ভেরো ই-৬ কোষের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কোষ বিভাজন শুরু করে।
এ সময় জিঙ্ক মাঝখানে এসে বাধা দেয়, দ্রুত প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে, যার ফলে ভাইরাসের কার্যকারিতা বাধাপ্রাপ্ত হয়। বয়স্কদের জিঙ্কের অভাব একটি সাধারণ বিষয়, তাই হয়তো তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। জিঙ্ক দিনে ২০-২৫ মিলিগ্রাম হিসাবে খেতে পারেন, তবে দিনে ২০০ মিলিগ্রামের বেশি খেলে শরীরের জন্য ক্ষতি হতে পারে। একটি গবেষণা বলছে, জিঙ্ক মিশ্রিত তরল দিয়ে গড়গড় করলে ভাইরাল ইনফেকশনের মাত্রা ৩৬ শতাংশ কমে যায়।
এবার জানব আয়রন সম্পর্কে। মাছ, মাংস, কলিজা, সবুজ শাকসবজি, বিশেষ করে কচুশাক, পুঁইশাক, ব্রকলি ও বীজজাতীয় খাবারে আয়রন পাওয়া যায়। কোভিড-১৯ একটি শ্বাসকষ্টজনিত রোগ। আয়রন আপনার শরীরে অক্সিজেন প্রবাহকে গতিশীল করবে।
এবার জানা যাক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সম্পর্কে। ভিটামিন সি, ভিটামিন ই, ক্যারোটিন ইত্যাদি হচ্ছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ। আমাদের শরীরে বিভিন্ন মানসিক চাপের প্রভাবে, প্রাণ-রাসায়নিক বিক্রিয়া ও বিভিন্ন ভেজাল খাদ্যের মাধ্যমে মুক্ত আয়রন (বলতে পারেন ব্রেকআপ হওয়া প্রেমিক-প্রেমিকা) উৎপন্ন হয়, যা পুনরায় অন্য কোনো ইলেকট্রনের সঙ্গে জোড়া বাঁধতে চায় এবং আমাদের শরীরের জোড়া আয়রনগুলোকে ভেঙে দিয়ে সুস্থ কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
এ সময় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এসে মুক্ত আয়রনগুলোকে আটকে ফেলে এবং সুস্থ কোষগুলোকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে। মধু, দই, আদা, রসুন, কাঁচা হলুদ, কালিজিরা, তিসি, আদা/লেবুর চা ইত্যাদি বেশি বেশি খান। অতএব বলা যায়, এসব খাবারের সমন্বয় আপনার শরীরকে চাঙা রেখে ভাইরাস বা অন্য কোনো ইনফেকশন থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে।
আমি বুঝতে পারছি, এ সময় অনেকের স্বাভাবিক খাবার সংগ্রহ করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তারপর আবার এতসব! এ ক্ষেত্রে বলব, যার পক্ষে যতটুকু সম্ভব ততটুকুই সংগ্রহ করার চেষ্টা করুন। এখানে উল্লিখিত প্রায় সবই আমাদের হাতের নাগালে পাওয়া যায়, শুধু প্রয়োজন একটু সচেতনতা। কাঁচা সবজি ও অর্ধসিদ্ধ খাবার, পচা-বাসি খাবার, ভাজা-পোড়া, বিশেষ করে পুরোনো তেলে উচ্চ তাপমাত্রায় ভাজা খাবার, প্রাণিজ চর্বি, জন্মদিনের কেক বা রুটির উপরে ব্যবহৃত ক্রিমসহ সব ট্রান্সফ্যাট খাবার, ধূমপান ও মাদক গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন। ঘরে থাকুন, হালকা ব্যায়াম করুন, মাল্টি ভিটামিন মিনারেল ট্যাবলেট খেতে পারেন, ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পরিহার করুন। অন্যান্য খাবার অবশ্যই গরম করে খান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, জনসমাগম এড়িয়ে চলুন।
নিজে সুস্থ থাকুন, অন্যকে সুস্থ রাখুন।
ড. মুহাম্মদ শফিউর রহমান : সহকারী অধ্যাপক, খাদ্য প্রকৌশল ও প্রযুক্তিবিদ্যা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ