দেশে মাদরাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় সাধারণত দুটি ধারা রয়েছে। একটি হলো ‘আলিয়া’, অন্যটি ‘কওমি’। এই দু’টির মধ্যে কোনটিতে ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতনের ঘটনা বেশি ঘটছে, তা নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার (১৫ এপ্রিল) ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনায় উঠে আসে, দেশে মেয়েশিশুদের মতো ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি খুব একটা প্রকাশ্য আলোচনায় উঠে আসছে না।
ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় বক্তারা বলেন, ছেলে শিশুদের যৌন নির্যাতনে আইনি পদক্ষেপ ও বিচার নিয়ে পুলিশ, আইনজীবীদের মধ্যেও রয়েছে অস্পষ্টতা। এ ছাড়া নৈতিক শিক্ষা না পাওয়া, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেও এসব নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে।
‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু যৌন নির্যাতন বন্ধে করণীয়’ শীর্ষক আলোচনায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কো-অর্ডিনেটর অর্পিতা দাশ মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
তিনি বলেন, এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চে ২০ জন শিশু যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে। এ সময় খোলা থাকা কিছু মাদরাসা, কলেজ ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসব ঘটেছে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনামের ধারণা, স্কুলে, মাদরাসায় শিশু ধর্ষণের যে ঘটনা ঘটে, বাস্তবে সে সংখ্যা আরও বেশি। তিনি বলেন, (শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে) কওমি মাদরাসা নিয়ন্ত্রণের বাইরে। সেটাই উদ্বেগের।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মুহাম্মদ আউয়াল হাওলাদার বলেন, নির্যাতন রোধে পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা চালু করতে হবে, যা পরে রাষ্ট্রে ছড়িয়ে যাবে। মাঠপর্যায়ে এসব ঘটনা ঘটে। তাদের সঙ্গে কেন্দ্রের যোগাযোগ নেই। মাঠ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে সচেতনতামূলক বক্তব্য ও চিন্তাচেতনা পৌঁছে দিতে হবে।
আলিয়া মাদরাসাগুলোই শুধু মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডের অধীন জানিয়ে বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. কামাল উদ্দিন বলেন, মাদরাসায় ছেলেশিশুদের ওপর যৌন হয়রানির ঘটনা বেশি ঘটে। যার মধ্যে বেশির ভাগই কওমি ধারার মাদরাসা। সেখানকার বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র হওয়ায় দুর্বৃত্তরা সুযোগ নেয়। তিনি বলেন, দেশে কী পরিমাণ মাদরাসা থাকবে, তার একটা জরুরি নিয়ম করা উচিত। সরকারি মাদরাসাগুলো সরকার একটা ব্যবস্থার মধ্যে আনতে চাইলেও তা পরাহত অবস্থায় আছে। কওমি মাদরাসা ইস্যু কেন যেন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। যে কেউ চাইলেই কওমি মাদরাসা করতে পারবে না, এমন একটা কঠোর নিয়ম থাকতে হবে।
মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের প্রকাশনা নিয়ন্ত্রক রিয়াদ চৌধুরী বলেন, মাদরাসার সম্পর্কে একটা ধারণা স্পষ্ট করা দরকার। দুটো ধারা আছে, আলিয়া ও কওমি মাদরাসা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে (ধর্ষণের ঘটনা) কওমি মাদরাসায় ঘটছে। তিনি বলেন, শিশুদের প্রতি যৌন নির্যাতন বন্ধে প্রতিষ্ঠান, অভিভাবক, সিভিল সোসাইটির সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। এ ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফি পুরোপুরি বন্ধ করে নৈতিক অবনমন কমাতে হবে। পাশাপাশি কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ চলবে না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে শূন্য সহিষ্ণু নীতি মেনে চলতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শাহনাজ হুদা বলেন,‘আমাদের দণ্ডবিধিতে ধর্ষণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করতে হবে। ধর্ষণ ও যৌন অত্যাচার, শিশুর ওপর নির্যাতনের ফলে মানসিক আঘাত পেয়ে তারাই কিন্তু পরে এর অপব্যবহারকারী হিসেবে গড়ে উঠছে।’
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের আইনজীবী আবদুর রশিদ বলেন, ‘এ ক্ষেত্রে (শিশু ধর্ষণ) আইনের কাছে যখন যাচ্ছি, তখন বিচারের ক্ষেত্রে দুই নীতি। কন্যাশিশু নির্যাতিত হলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে যেতে পারেন। কিন্তু এখানে ছেলেশিশু হলে কী হবে, তা নিয়ে অস্পষ্ট একটা ব্যাখ্যা। সেটা অস্পষ্টতা রয়েছে থানা,পুলিশ, আইনজীবীদের মধ্যে।’
তিনি বলেন, ছেলেশিশু যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারায় ‘অস্বাভাবিক অপরাধ’ নামে একটি বিষয়ের উল্লেখ আছে, যেখানে এর স্পষ্টতা নেই। এই ভিন্নতার কারণে অপরাধের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ছেলেশিশুদের বিচার করার ক্ষমতা ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে। ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের বিচারকে অপরাধীরা খুব হালকা ভাবে নেন। ছেলেদের নির্যাতনের বিচার একটি ট্রাইব্যুনালে করার দাবি জানান তিনি।