আমার কণ্ঠ রিপোর্ট॥
সবার প্রিয় শিক্ষক, মানুষ গড়ার কারিগর, হাজীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক, ১৯৯৮ সালের দেশের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক মরহুম কাজী বজলুল হক এর ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ ২৬ মে রবিবার।
২০০৩ সালের ২৪ মে শুক্রবার জুমা নামাজ পড়ার জন্য নিজ বাসা টোরাগড় কাজী ভিলা থেকে বের হয়ে পৌর ভবনের সমনে দিয়ে মসজিদের দিকে যাওয়ার পথে অপর দিকে থেকে আসা একটি মোটর সাইকেল ধাক্কা দিলে ঘটনরার স্থলে গুরুতর আহত হয় কাজী বজুলুল হক। সাথে সাথে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক মরহুম কাজী বজলুল হককে ঢাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। তার অবস্থা আশংঙ্কা জনক দেখে তাকে আইসিউতে রাখা হয়।
২৬ মে সকালে সবার প্রিয় কাজী বজলুল হক সবাইকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে। তাঁর মৃত্যুর সংবাদ হাজীগঞ্জসহ বিভিন্ন জায়গায় পৌছার সাথে সাথে চারদিকে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার মরদেহ কর্মস্থল হাজীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুল এন্ড কলেজ মাঠে আনা হলে হাজার হাজার ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবক ও কাজী বজলুল হকের প্রাক্তন ছাত্রছাত্রীরা তাঁকে শেষ বারের মতো দেখতে আসেন।
আজ তাঁর ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর নিজ বাড়ী টোরাগড় কাজী ভিলাতে মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে বাদ আসর। মিলাদ মাহফিলে সকল স্তরের মানুষদেরকে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে তাঁর বড় ছেলে কাজী আনোয়ারুল হক হেলাল, মেজো ছেলে ডাঃ কাজী মোস্তফা সারোয়ার (অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদা মহাপরিচালক,পরিবার পরিকল্পা অধিদপ্তর),তৃতীয় ছেলে কাজী মাহাবুবুল আলম জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজেষ্ট্রট গোপালগঞ্জ, একমাত্র মেয়ে তানজিনা ফেরদৌস উপধ্যক্ষ তেজগাঁও সরকারী বিজ্ঞান কলেজ ঢাকা)।
কাজী বজলুল হকের জীবনী
কাজী বজলুল হক ১৯৩৮ সনের ৩০ অক্টোবর চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জ উপজেলার পালিশারা গ্রামের সম্ভ্রান্ত কাজী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা কাজী আলীমুদ্দিন এবং মাতা ছাম্মিয়া খাতুন।
শিক্ষাগত অর্জন: পালিশারা প্রাইমারী স্কুলে তাঁর শিক্ষা জীবনের হাতে খড়ি। সেই স্কুল থেকে ১৯৪৮ সনে তিনি জুনিয়র বৃত্তি লাভ করেন। সপ্তম শ্রেণি থেকে শাহরাস্তি হাই মাদ্রাসায় পড়াশুনা করে ১৯৫৩ সনে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে মেধা তালিকায় ৬ষ্ঠ স্থান অধিকার করেন। ১৯৫৫ সনে লাকসাম পশ্চিমগাঁও ফয়েজুন্নেছা কলেজ থেকে আই,এ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এবং মেধা তালিকায় ৩য় স্থান দখল করেন। ১৯৫৭ সনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে উচ্চতর ২য় বিভাগে বি, এ পাস করেন। উল্লেখ্য যে, তখনকার দিনে পাস কোর্সে কেহ প্রথম বিভাগ পেতনা। ১৯৬২ সনে ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজ থেকে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন ও মেধা তালিকায ৫ম স্থান অধিকার করেন।
পেশাগত জীবন: ১৯৫৭ সনেই পালিশারা হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হন। ১৯৬৩ সালে রাঙ্গুঁনিয়া হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি লাকসাম পাইলট হাই স্কুল এর সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে হাজিগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ঐ সময়ে প্রায় প্রত্যেক বছরই হাজিগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলের ছাত্ররা বোর্ড পরীক্ষায় বিভিন্ন বিভাগে মেধা তালিকায় স্থান পেত। মেধাবী ছাত্রদের অনেকেই দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত¦পূর্ণ পদে বহাল আছেন। ২০০৩ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০ বছর প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুনামের সাথে কর্মরত ছিলেন।
পুরষ্কার ও স্বীকৃতি: ১৯৭৩ সনে ১লা জানুয়ারি থেকে আমৃত্যু হাজিগঞ্জ পাইলট হাই স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ স্কুলে তাঁর শিক্ষকতার সময়ে প্রায় প্রত্যেক বছরই এ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা বোর্ডের পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান পেতো। তদুপরি জুনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায়ও ট্যালেন্টপুল এবং সাধারণ গ্রেডে উপজেলা কোটার অধিকাংশই এ স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরা দখল করে থাকতো। শিক্ষকতা জীবনে সাফল্যের স¦ীকৃতিস¦রূপ জাতীয় পর্যায়ে দু‘বার স¦র্ণপদকে ভূষিত ও সনদপত্র প্রাপ্ত হয়েছেন। জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহ, ১৯৮৯ তে শ্রেষ্ঠ জাতীয় শিক্ষক হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃত ও সনদ প্রাপ্ত হয়েছেন। শ্রেষ্ঠ প্রধান শিক্ষক হিসেবে ১৯৯৮ সনে জাতীয় পর্যায়ে স¦র্ণ পদকে ভূষিত হন এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমপি এঁর নিকট হতে স্বর্ণপদক ও সনদ গ্রহণ করেন।
পারিবারিক বৃত্তান্ত: তাঁরা তিন ভাই ও দু’বোন। এর মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। বড় বোন মিসেস আমেনা বেগম, বড় ভাই কাজী ছিদ্দিকুর রহমান, ছোট ভাই কাজী সিরাজুল হক, ছোট বোন আনোয়ারা বেগম ১৯৫৫ সালে তিনি বেগম তফুরুননেছা এর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁর চার পুত্র ও এক কন্যা। ১ম পুত্র কাজী আনোয়ারুল হক। তিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। ২য় পুত্র ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ার। তিনি সরকারের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক। ৩য় পুত্র কাজী মাহবুবুল আলম। বর্তমানে তিনি গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কর্মরত। ৪র্থ পুত্র কাজী মাজহারুল হক সোহাগ কাকৈরতলা সিনিয়র মাদ্রাসার বাংলা বিভাগের প্রভাষক হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ২০০৫ সালের ১৫ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে তানজিনা ফেরদৌস। তিনি বর্তমানে উপাধ্যক্ষ, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ, ঢাকা। বড় পুত্রবধু ফাতেমা আকতার হাজিগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক। দ্বিতীয় পুত্রবধূ সুরাইয়া সারোয়ার গৃহবধূ। তৃতীয় পুত্রবধূ কানিজ ফাতিমা মিতু অস্ট্রেলিয়ার থেমস কলেজের বাংলাদেশের কান্ট্রি ম্যানেজার। একমাত্র জামাতা জনাব আবুল বাশার বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের অবসরপ্রাপ্ত এজিএম। কাজী বজলুল হকের ৫ জন নাতনী। উল্লেখ্য যে, তাঁর আদর্শ গৃহিনী বেগম তফুরুননেছার নামে পালিশারা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তফুরুননেছা ১০ শয্যাবিশিষ্ট মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র।
মৃত্যুবরণ: তিনি হাজিগঞ্জ পাইলট হাই স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কর্মরত অবস্থায় ২০০৩ সালের ২৩ মে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ^বিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০০৩ সালের ২৬ মে মৃত্যুবরণ করেন।
পরিবারের উদ্যোগে কাজী বজলুল হক ফাউন্ডেশন বর্তমানে রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উক্ত ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে অসচ্ছল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বার্ষিক বৃত্তি প্রদান, নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের সম্মাননা, শিক্ষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে অনন্যসাধারণ অর্জনকারীদের বিশেষ সংবর্ধনা এবং নতুন প্রজন্মের মাঝে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিকাশে বিভিন্ন ধরনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে। এছাড়া আর্ত মানবতার সেবায় এবং সমাজকল্যাণমূলক কাজে এ ফাউন্ডেশন কাজ করবে। এ ফাউন্ডেশন এর উদ্যোগে কাজী বজলুল হকের নামে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যা বর্তমানে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।